[২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইরান সোসাইটির ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও ও রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকার। এখানে বাংলায় ইরানি ঐতিহ্য ও ইতিহাসের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। অন্যদিক স্বাধীন সুলতানদের আমলেই বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয়। বাংলা ভাষার বিকাশে এই বিদেশি ভাষাটির ভূমিকাও উঠে এসেছে লেখাটিতে।]

অষ্টম শতক থেকে আরব ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকদের সঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতি বাংলায় প্রবেশ করেছিল। তবে ১২০৪ সাল থেকে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হয় কারণ এই সময় ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার সেন বংশকে উৎখাত করে শাসন ক্ষমতা দখল করেন।

৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমি কলকাতার ইরান সোসাইটিকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এই অর্জন কোনও অংশে কম নয়। সেই সঙ্গে “পারসিয়ান'পারসিয়ান হেরিটেজ অফ বেঙ্গল' বিষয়ে তিন দিবসীয় আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজনের জন্যেও তাঁদের অভিবাদন। ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার ঘনিষ্ঠ যোগ এবং এই সূত্রে বাংলা নানাভাবে উপকৃতও। তাই এই বিষয়ে আলোচনার এটি যথোপযুক্ত সময়ও বটে।

আমরা সবাই জানি অষ্টম শতক থেকে আরব ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকদের সঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতি বাংলায় প্রবেশ করেছিল। তবে ১২০৪ সাল থেকে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হয় কারণ এই সময় ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার সেন বংশকে উৎখাত করে শাসন ক্ষমতা দখল করেন। এভাবে বাংলা হয়ে ওঠে দিল্লির নব্য প্রতিষ্ঠিত সুলতান বংশের অন্যতম পূর্বতম প্রদেশ। এই সুলতানি বংশ আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পারস্যায়িত তুর্কদের হাতে । এই বিজয় এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। মধ্যযুগীয় ইরানিয় বিশ্বের অধীনে চলে আসে বাংলা। এই ইরান আব্বাসিদের শাসনে বিবর্তিত হয়েছে। স্থানীয় তুর্কি শাসকরা ফারসিকে যোগাযোগের ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহার করতেন। কারণ বিভিন্ন এথনিক তুর্কি ও আফগান গোষ্ঠীর নিজস্ব জেলার ভাষা ও উপভাষা ছিল যা মূলত মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের। তবে ফারসি সবাই বুঝতে পারতেন। তুর্কি অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ায় কেবলমাত্র একটি জনগোষ্ঠী ছিল যারা ফারসির পূর্বাঞ্চলীয় আঙ্গিকে কথা বলত ও লিখত। এরা হল তাজিক গোষ্ঠী। এদের ভাষা ও সংস্কৃতি আধুনিক তাজিকিস্তানেই শুধু প্রসারিত নয় সেইসঙ্গে উজবেকিস্তানের বোখারা ও সমরখন্দের শহরগুলিতেও এর প্রভাব রয়েছে। আমরা এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করছি কারণ ইসলামি বাংলায় প্রথমদিকে ফারসি বিশারদরা অধিকাংশই ছিলেন তাজিক। ইরান থেকে ফারসিভাষী ও আফগানিস্তান থেকে সহ ভাষাবিদ দারিদের এদেশে বিপুলসংখ্যায় আসার আগে পর্যন্ত।

তাঁদের আগমনের অব্যবহিত পরেই বাংলার মুসলিম শাসকরা পারস্যের অনুকরণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম কানুন চালু করেন এবং এর বিস্তর প্রভাব পড়েছিল স্থানীয় মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিতে। প্রথম বড় বদল ছিল রাজতন্ত্র ও রাজ্যশাসন কার্যের ফারসি ঐতিহ্য যা ঘটনাচক্রে প্রাকইসলামি এবং এটি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল গৃহস্থালী সামরিক ও রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃত আমদানিকৃত দাসদের উপর। দ্বিতীয় বড় বৈশিষ্ট্য ছিল উচ্চ মাত্রার বাণিজ্যিকীকরণ যার ফলে এক নগদী অর্থনীতির জন্ম হয়েছিল। বাংলায় উভয়ই ছিল নতুন। তবে তারা সফলভাবে তা আত্মীকরণ করে নিয়েছিল। সাসানীয় সাম্রাজ্যের অনুকরণে গৌড় ও পান্ডুয়া দরবার সংস্কৃতি শুরু করেছিল। রাষ্ট্রপরিচালনার এক নির্দিষ্ট শৈলীর সংস্পর্শে আসে বাংলা যা যৌক্তিকভাবে অবস্থিত ছিল স্বচ্ছ ও মান্য আইনি বিধির উপর এবং একে কার্যকরী করতেন প্রশিক্ষিত আমলারা। আগের হিন্দু ও বৌদ্ধ জমানার চেয়ে এ ছিল বেশ ভিন্ন। পারসিয়ান কায়দার এই রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি এতটাই সফল হয়েছিল যে, ১৩৫২ সালে দিল্লির সুলতানদের থেকে বাংলার সুলতানরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরও অব্যাহত ছিল। বাংলার সুলতানরা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেছিলেন। আমরা দেখতে পাই যে ইলিয়াস শাহী সুলতানরাও জোর দিয়েছিলেন 'খলিফাতন্ত্র ও ইরানি সংস্কৃতির উপর' (করিম ১৯৬০ পৃ . ১৮ ) । ১৩৭৫ সালে পান্ডুয়ায় নির্মিত মহান আদিনা মসজিদ প্রতিফলিত করেছিল এক স্বতন্ত্র রাজকীয় দিককে — সাসানীয় ইরানের রাজকীয় শৈলীর ছায়া রয়েছে এতে। ১৪৩০-এর দশকে, আমরা দেখতে পাই জালাল-উদ-দিনের একলাখি সমাধিস্তম্তের মাধ্যমে পারসি সংস্কৃতির উপর কীভাবে বাংলার প্রভাব পড়তে শুরু করল এবং তাও বিশাল আকারে । বাংলার বোদ্ধ স্থাপত্যের চিহ্ ছিল এই সমাধিস্তস্তে এবং ভবন নির্মাণের স্থানীয় ও লৌকিক রীতিও গৃহীত হয়েছিল। সুলতানদের সক্রিয় উৎসাহে উঠে এসেছিল স্থাপত্যের এক নতুন টিপিক্যাল বাঙালি শৈলী।

যে বিষয়টি অল্প পরিজ্ঞাত তা হল, ত্রয়োদশ শতকে পারস্যায়িত তুর্কিরা আসার আগে বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলে ধাতুর মুদ্রার প্রচলন ছিল না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্য ও অর্থনীতির হাল ছিল মন্থর এবং স্বল্প মূল্যের আদানপ্রদানের জন্য ছিল গো-বিনিময় প্রথা । তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এই অঞ্চলের হিন্দু রাজাদের ভান্ডারে ছিল বিপুল পরিমাণে কাঁচা রুপো। এ ই ছিল তাদের সম্পদের একটা বড় অংশ। এর আকর্ষণেই আসত লুষ্ঠনকারী ও বিজয়ীরা। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিটি পর্বে ধাতব মুদ্রা তৈরি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তা ছিল সুলতানের স্বীকৃতির চিহ্বস্বরূপ খোদাই করা। ডেয়েলের মত অনুযায়ী রুপোর কয়েন বা বাংলার 'টঙ্কা'য় ভর করে আগের ধীর গতিসম্পন্ন বাণিজ্য ও উৎপাদনের চাকা দারুণভাবে গড়াতে শুরু করে ( ডেয়েল পৃ . ২২৭ ) । অর্থনীতি নির্দিষ্ট একটি চেহারা নেয়। রাজনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠিত হতে থাকে দ্রুত এবং রাজস্ব ও পরিসম্পদের উপর ভিত্তি করে শাসকদের শ্রেণি নির্ধারিত হতে থাক সাধারণত ধাতব মুদ্রার নিরিখে। পার্সি শাসনের অন্যতম অবদান ছিল পেশাদারী ও বেতনভূক প্রশাসনিক পরিকাঠামো নির্মাণ যা ছিল স্বচ্ছ ও বহু-স্তরীয়। এইভাব স্থানীয় আধিকারিকরা নিজেদের উন্নতি সাধনে বা টিকে থাকতে বাহিনীর খেয়ালি ব্যবহারের উপর কম নির্ভর করতেন।

বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিরিখে পরবর্তী বড় প্রভাব জেগে উঠেছিল ভাষা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে। আমরা যেমনটা দেখব অন্য ভাষাগুলি সংস্কৃত বা আদি তামিলের বিচ্যুতির পথ ধরেছিল এবং ভাষা গড়ে উঠেছিল । কবি জয়দেব সংস্কৃতে 'গীতগোবিন্দ' রচনা করেছিলেন এবং এই চিরায়ত সাহিত্যকে বাংলা বিহার ওড়িশা ও অসমের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও তখনও পর্যস্ত এই অঞ্চলগুলির একান্ত নিজের ভাষা গড়ে ওঠেনি। মূল কথা হল এই রচনার কয়েক দশক পরে মুসলিমরা যখন বাংলা জয় করলেন তখন বাংলা ভাষা প্রাক গাঠনিক স্তরে ছিল এবং তখনও পূর্ণ রূপ প্রাপ্তি বা স্বীকৃতি থেকে দূরে। ভাষাতাত্বিকদের মত দশম বা একাদশ শতক থেকে বাংলা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হচ্ছিল যখন 'চর্যাপদ' লেখা হচ্ছিল। আমাদের অন্বিষ্ঠভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে, চতুর্দশ শতকে বাংলাকে স্বাধীন ভাষা হিসেবে 'মুক্তি' দিতে তুর্কি শাসক ও তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ফারসি ভাষা কোন ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলায় মুসলিম বিজয়ের প্রায় দেড় শতক পরে সিসতানি তুর্কি শাসক সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহী ইতিহাসে প্রথমবার যখন বাংলার ভাঙা টুকরোগুলিকে জোড়া দিলেন তখন এক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। ১৩৫২ সালে দিল্লির সুলতানদের থেকে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন ইলিয়াস শাহ এবং সেইসঙ্গে নিজেকে বাংলার মানুষের শাসক হিসেবে ঘোষণা করে হন “শাহ বাঙ্গালিয়ান”। এই প্রথমবার এক নির্দিষ্ট রাজত্ব বা দেশ হিসেবে বাংলা ইতিহাসে নথিভুক্ত হল — বাংলার বিভিন্ন খণ্ডিত অংশ যেমন গৌড়, সাতগাঁও, পৌণ্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল্লা ভাঙা বা সোনারগাঁও ( মুরশিদ ৩৫ ) হিসেবে নয়। ইলিয়াস শাহী ও তীর উত্তরসুরিরা কেবল ঘোষণা করেনি ক্ষান্ত হননি বরং দুই শতকের বেশি সময় ধরে বাংলা যাতে পৃথক স্বায়ত্তশাসিত সুলতানি সাম্রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে তা নিশ্চিত করেছিলেন। যদিও দিল্লি বেশ কয়েকবার একে দখল করার উদ্যোগ নিয়েছে। দিল্লির এই আগ্রাসন রোধ করতে ইলিয়াস শাহী শাসকদের দরকার ছিল স্থানীয় মানুষদের সমর্থন ও সহযোগিতা । ইতিহাসে তাঁরাই প্রথম সরকারি কর্তৃপক্ষ যারা বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বাকি উত্তর ভারতের তুলনায় এ ছিল বেশ পৃথক। যদিও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু অভিজাতদের এই নিয়ে অনেক বিপরীত বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু যে সত্যটা রয়ে গেছে সেটা হল ভাষা হিসেবে সংস্কৃত থেকে ভেঙে বাংলা বেরিয়ে এসেছিল এবং স্বাধীন সুলতানদের আমলেই এই ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয়। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সুলতানরাই। বাংলার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, সামাজিক নেতা ও পুরোহিত শ্রেণি এতে খুশি হননি এবং তাঁরা সংস্কৃত ভাষার ব্যবহারই চালিয়ে গিয়েছেন। তথাকথিত নিম্ন শ্রেণির মানুষের ভাষাকে ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করেই। তব চন্ডীদাসের মতো দরিদ্র গ্রামীণ ব্রাহ্মণ এই ধরনের বর্ণবাদী হুকুমাদেশে তেমনভাবে কর্ণপাত করেননি। এই সময়কালে তিনি পথ দেখিয়েছিলেন বাংলায় রচনা করেছিলেন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। এর রচনাকাল নিয়ে মত বিভেদ রয়েছে তবে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এক শতকের মধ্যেই হবে। এরই কাছাকাছি সময়ে আমরা মিথিলার বিদ্যাপতির কথা জানতে পারি। লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী অধিগ্রহণ করার পর বাংলায় তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার দুই শতকের বেশি সময় পরে বিদ্যাপতির রচনা বিকাশ লাভ করেছিল। যদিও বাংলা বিহার ও ওড়িশার মানুষ তাকে নিজেদের বলে দাবি করেন। যেহেতু ভাষাটি প্রায় একই। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বাংলার জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের এই নব্য সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করেছিলেন মুসলিম লেখকরাও । শাহ মুহাম্মদ সাগির তাঁর 'ইউসুফ জুলেখা'তে আরবি ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার করেন। সম্ভবত পঞ্চদশ শতকের শুরুর দশকে তিনি পবিত্র কুরআনের শিক্ষার উপর জর দেন, জোর দেন ইসলামি শিক্ষার উপরেও। ধর্মীয় আখ্যান থেকে তিনি ভালোবাসার গল্প তুলে আনেন। বিষয় যদিও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধার করে আনা । তবে পটভূমি ছিল বাংলারই ব্যবহৃত হয়েছে স্থানীয় প্রবাদ প্রবচন এবং এর স্বাদও বঙ্গীয়। যাই হোক লিখন অন্বয় ব্যাকরণ ও উচ্চারণ সুসংহত হতে বাংলা ভাষায় সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় দুই হাজার বছর। তবে তুর্কি-ফারসি শাসকদের বদান্যতায় সাধারণ মানুষের অসংগঠিত ভাষা দরবারের স্বীকৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল।

বাংলাভাষী মানুষদের একই রাজত্বের মধ্যে সংঘবদ্ধ করার শামসুদ্দিনের যে সিদ্ধান্ত তার সাত দশক পরে, বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই চৈনিক পর্যটক মা হুয়ানের কাছ থেকে। ১৪২৫ ও ১৪৩২ সালের মধ্যে তিনি বাংলায় এসেছিলেন এবং নথিভুক্ত করে গিয়েছেন যে সুলতানের দরবারে ফারসি সরকারি ভাষা হলেও বাংলা ভাষা সর্বজনীনভাবে এখানে উপস্থিত

বাংলাভাষী মানুষদের একই রাজত্বের মধ্যে সংঘবদ্ধ করার শামসুদ্দিনের যে সিদ্ধান্ত তার সাত দশক পরে, বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই চৈনিক পর্যটক মা হুয়ানের কাছ থেকে। ১৪২৫ ও ১৪৩২ সালের মধ্যে তিনি বাংলায় এসেছিলেন এবং নথিভুক্ত করে গিয়েছেন যে সুলতানের দরবারে ফারসি সরকারি ভাষা হলেও বাংলা ভাষা সর্বজনীনভাবে এখানে উপস্থিত ( মা হুয়ান পৃ . ১৬১ ) । এই সময়ের কাছাকাছি পর্বে, বিশ্বাস করা হয় যে সুলতান জালালউদ্দিন রামায়ণকে সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে কৃত্তিবাস ওঝাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি যা করেছিলেন তা বাংলা ভাষার উন্নতির ক্ষেত্রে এক মাইলফলক। ওঝা কিছু টিপিক্যাল বাঙালি ধারণা ও উপাদান নিয়ে এসেছিলেন তার রচনায়। এই শতক, ১৪৮০ সাল নাগাদ, সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ তার হিন্দু দরবারি মালাধর বসুকে বাংলায় 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়' রচনা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। পরের কয়েক দশকে নুসরত শাহ পরাগল খাঁ ও ছুটি খায়ের মতো শাসকরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে ভীষণভাবে জোর দেন। বাংলা ভাষায় উন্নতিতে পারস্যায়িত তুর্কি শাসকদের যে বিপুল ভূমিকা তার ততখানি স্বীকৃতি দেওয়া হয় না বা যেটুকু স্বীকৃতি দেওয়া হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। সুলতান ও ইরানের ভাষার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের ফলে বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে অজস্র ফারসি ও আরবি শব্দ স্বাভাবিকভাবেই। বাংলাদেশি পণ্ডিতরা গণনা করে দেখিয়েছেন বাংলায় ৫ হাজারের বেশি শব্দ ও অভিপ্রকাশের উৎস ফারসি আরবি। বেশিরভাগ ফারসি। মজার বিষয় হল হিলালি উল্লেখ করেছেন , 'এই শব্দ ও অভিপ্রকাশের বেশ কিছু বাংলায় এমনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে যে ধ্বনিতত্ব ও বানানের দিক থেকে সেগুলিকে চেনাই দায়’( হিলালি পৃ . ৫ ) । এর অর্থ হল ফারসি শব্দ ও

বিষয় হল হিলালি উল্লেখ করেছেন , “ এই শব্দ ও অভিপ্রকাশের বেশ কিছু বাংলায় এমনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে যে ধ্বনিতত্ব ও বানানের দিক থেকে সেগুলিকে চেনাই দায়” ( হিলালি পৃ . ৫ ) । এর অর্থ হল ফারসি শব্দ ও খণ্ডিত বাক্যগুলি বাঙালি উচ্চারণরীতির সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছে ও এমনভাবে বানান করা হয় যে বাংলাভাষীরাও উপলব্ধি করে না যে, তারা বিদেশি ভাষা উচ্চারণ করছে। এমনকি যারা শুনছে তারাও বুঝতে পারে না।

বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার সম্পর্কিত আমার একটি দারুণ অনুমান পেশ করার রয়েছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অন্যান্য ভাষাগুলি সংস্কৃত বা আরবি থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। কিন্তু হিন্দি বা উর্দুর মতো বাংলায় সাধারণ 'খাওয়া' শব্দ দিয়ে ধুমপান ও পান করা বোঝানো হয় যা সংস্কৃত মূল 'খানা' বা খাওয়া থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তবে আক্ষরিক স্তরে 'পানা' নামে একটি সংস্কৃত তৎসম শব্দ রয়েছে যা 'পান করা' কে বোঝায়। ধূমপান বা কোনও কিছু শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করাকেও বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়- 'ধূম্রপান' বা স্মোকিং। কিন্তু চলতি কথোপকথনের বাংলায় এগুলির ব্যবহার হয়ই না বললেই চলে। আমার বক্তব্য হল এর উৎসমূলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে মধ্যযুগীয় পারস্যে যেখানে 'খাওয়া' শব্দ দিয়ে তিন রকম ক্রিয়াকেই বোঝানো হ'ত। পরবর্তী কালে ফারসি ভাষায় প্রতিটির জন্য পৃথক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু জানা যাচ্ছ আজও ইরানি দারি ও তাজিকভাষীরা ধূমপান ও পান করাকে বোঝাতে সাধারণত 'খাওয়া' ক্রিয়া পদটি ব্যবহার করে থাকেন। বাঙালিরা এই প্রবণতা কোথা থেকে পেয়েছিলেন তা ব্যাখ্যা করতে আমার মনে এটা ছাড়া আর কিছু আসছে না। ফারসি দরবারে এগুলি যত্নে লালিত হয়েছিল। অপভ্রংশ থেকে যে চারটি ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল তার মধ্যে মৈথিলীর 'খাওয়া' নিয়ে এমন কোনও নির্দিষ্টতা নেই। পান করা ও ধূমপান বোঝাতে ওড়িয়া অবাধ 'পানা' ব্যবহার করে, কিন্তু মধ্যযুগীয় ফারসির অনুকরণে বাংলা ও অসমিয়া খাওয়া, পান করা ও ধূমপান বোঝাতে 'খাওয়া' শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। বাংলায় তা ছাড়া আমরা দেখি যে ক্রিয়াপদ লিঙ্গ অনুযায়ী পরিবর্তন হয় না। বাংলা ভাষার সরাসরি কোনও বিশেষ্য-ক্রিয়া-বিশেষণ সম্পর্ক নেই। আমরা দেখতে পাই চতুর্দশ থেকে যষ্ঠদশ শতকে ফারসি ভাষাও বাক্যের লিঙ্গভিত্তিক গঠন অনুসরণ করেনি। তবে আমাদের উল্লেখ করতে হবে বাংলা ভাষার উপর তিব্বতি-বর্মার প্রভাব পড়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে এর ব্যবহার ছিল। বাংলা সম্ভবত এই লিঙ্গ-শূন্য গঠন গ্রহণ করেছে তাদের থেকে এবং অসমিয়া ও ওড়িয়ারও একই ব্যাকরণগত প্রবণতা রয়েছ যেহেতু পূর্বাঞ্চলের এই তিন ভাষাই প্রতিনিধিত্ব করছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের। তবে মৈথিলী অনুসরণ করে ভারতীয় ভাষার প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিকতাকে, অর্থাৎ বিশেষ্যপদের লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রিয়াপদকে। এই থেকে আমাদের বিশ্বাস হয় যে চতুর্দশ শতকের দিকে মৈথিলীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যখন ইলিয়াস শাহী শাসকরা বাংলাকে যথার্থ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তাদের উৎসাহ ও তাদের লিঙ্গ মুক্ত ব্যাকরণ হয়ত বাংলার উপর প্রভাব ফেলেছিল অসমিয়া ও ওড়িয়ার চেয়ে বেশি। 'পূর্বাঞ্চলীয় ইকোসিস্টেমে' এই ভাষাগুলি প্রস্ফুটিত হয়েছিল। বাংলায় 'লিঙ্গবিহীন' বাক্য গঠন প্রকটভাবে বিদ্যমান রয়েছে। খুব সম্ভবত বাংলা ভাষার এই প্রবণতা ফারসিভাষী শাসকদের প্রভাবের ফলে গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। তাদের শাসনামলে শৈশবে উপনীত হওয়া বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক পর্বের এটা আরেক বৈশিষ্ট্যও।

তরজমা : জিয়াউল হক


ইন্দো-ইরানিকা কলকাতার ইরান সোসাইটির ত্রৈমাসিক পত্রিকাতে
(ভলিউম ৭২, সংখ্যা ১- ৪, ২০১৯ ) প্রকাশিত
তথ্যসূত্র
১।জে ডেয়েল, দ্য চায়না কানেকশন : প্রবলেমস অফ সিলভার সাপ্লাই ইন মেডিএভ্যাল বেঙ্গল। জে এফ রিচার্সের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'প্রিসিয়াস মেটালস ইন লেটার মেডিয়েভ্যাল অ্যান্ড আর্লি মডার্ন ওয়ার্ল্ডস

২ / জি এম হিলালি, পার্সো-অ্যারাবিক এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি

৩ / আবদুল করিম, কপার্স অফ দ্য মুসলিম কয়েনস অফ বেঙ্গল, এশিয়াটিক সোসাইটি অফ পাকিস্তান

৪ 1 মা হুয়ান, ইঙ্গ-ইয়াই শেঙ্গ ল্যান : দ্য ওভারতল সার্ভে অফ দ্য ওসেনস শোরস

৫ / গোলাম মুরাশিদ, বেঙ্গলি কালচার ওভার এ থাওজ্যান্ড ইয়া্‌ নিয়োগী বুকস

No comments on 'বাংলা ও তার ফারসি উত্তরাধিকার'

Leave your comment

In reply to Some User