সভ্যতার ইতিহাসে ভারতের সবচেয়ে শক্তিমান সাংস্কৃতিক রফতানিটি হল বৌদ্ধ দর্শন, যে দর্শন শান্তি ও অহিংসার আদর্শকে তুলে ধরে।
কূটনীতিতে ‘সফ্ট পাওয়ার’ কথাটা খুব প্রচলিত। একটি দেশ অন্যান্য দেশের উপর নিজের সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারলে যে কূটনৈতিক শক্তি অর্জন করে, সেটাই সফ্ট পাওয়ার। অনেকের মতেই, ভারতের এই ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। কী ভাবে? মনে রাখা দরকার, সভ্যতার ইতিহাসে ভারতের সবচেয়ে শক্তিমান সাংস্কৃতিক রফতানিটি হল বৌদ্ধ দর্শন, যে দর্শন শান্তি ও অহিংসার আদর্শকে তুলে ধরে। এই প্রসঙ্গেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল বেশক-এর দিনটি, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে যে দিনটি বুদ্ধপূর্ণিমা হিসেবে পালিত হয়। অনেক দেশেই এমন নানা হিন্দু বা বৌদ্ধ উত্সব জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু মানুষ তাদের ভারতীয় উত্সের কথা ভুলে গেছে।
বেশক-এর উৎস অবশ্য অবিস্মরণীয়, কারণ দুনিয়া জুড়ে বৌদ্ধরা মনে করেন, এই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে গৌতম বুদ্ধের জন্ম এবং আশি বছর পরে এই তিথিতেই তাঁর মহাপরিনির্বাণ। আমাদের সব বেদনার মূলে আকাঙ্ক্ষা, তাই বাসনা বর্জনই মুক্তির পথ— বুদ্ধের এই শিক্ষা গোটা মানবজাতি মনে রেখেছে। খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ শতাব্দী আগে ভারতে এই দর্শনের সৃষ্টি। দ্রুত তা এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বুদ্ধ ও খ্রিস্টের শিক্ষার সাদৃশ্যের কথা অনেক পশ্চিমী পণ্ডিতই লক্ষ করেছেন। যেমন বার্বারা ওয়াকার লিখেছেন, ‘‘নানা বৌদ্ধ উপকথা ও বাণী গসপেল-এ ‘খ্রিস্টীয় উপদেশ’ রূপে স্থান পেয়েছে।’’ মার্ক টাট্স এবং জোডি কেন্ট আবার মনে করেন, ক্রিস্টধর্মের ‘মিরাক্ল’-এর ধারণার পিছনে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জলের উপর হাঁটা বা সশরীর স্বর্গারোহণের কাহিনিগুলির অবদান আছে। বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর প্রথম সুসংগঠিত ও সকলের জন্য উন্মুক্ত ধর্ম। খ্রিস্টধর্ম এবং এমনকী হিন্দুধর্মের উপরেও তার অনেক প্রভাব। ক্রিস উইলিয়মস-এর মতে তার কয়েকটি হল ব্রহ্মচর্য, উপবাস, আরাধনার বেিদতে প্রদীপ ও ফুলের ব্যবহার, পবিত্র সুগন্ধি ও জল, জপমালা, পুরোহিতের বিশেষ বস্ত্র, সন্তদের উপর বিশেষ মহিমা আরোপ, ধর্মানুষ্ঠানে প্রাচীন ভাষা ব্যবহার ইত্যাদি। বুদ্ধের এই পূর্ণিমায় এত দেশে তাঁর আরাধনা হবে, সেটা স্বাভাবিক। ভারতেও এই দিনটির পবিত্রতা স্বীকৃত, কিন্তু বৌদ্ধ ছাড়া অন্যেরা একে বড় উত্সব হিসেবে পালন করেন না। এটা লক্ষ করার ব্যাপার যে, বৌদ্ধধর্ম তার জন্মভূমিতে যথেষ্ট মর্যাদা পায়নি। বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার রূপে গণ্য করা হলেও এ দেশে কোনও একটি হিন্দু মন্দিরেও তিনি একাকী পূজিত নন। বস্তুত, নিয়ো-বুদ্ধিস্টদের উত্থান না হলে বৌদ্ধধর্ম ভারতে এখন যে গুরুত্বটুকু পায় সেটুকুও পেত না।
বৌদ্ধপূর্ণিমা চান্দ্র ক্যালেন্ডার ধরে পালিত হয়, ফলে বিভিন্ন বছরে এটি বিভিন্ন দিনে পড়ে, এবং ফসল তোলার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই, ইসলামের নানা পরবের মতোই এ ক্ষেত্রেও মাহাত্ম্যটা চান্দ্র তিথির অন্তর্নিহিত।
বৌদ্ধপূর্ণিমা চান্দ্র ক্যালেন্ডার ধরে পালিত হয়, ফলে বিভিন্ন বছরে এটি বিভিন্ন দিনে পড়ে, এবং ফসল তোলার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই, ইসলামের নানা পরবের মতোই এ ক্ষেত্রেও মাহাত্ম্যটা চান্দ্র তিথির অন্তর্নিহিত। ১৯৫০ সালের মে মাসে ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুদ্ধিস্টস সংগঠনের প্রথম সম্মেলনে স্থির হয়েছিল, মে মাসের প্রথম পূর্ণিমায় এ উত্সব পালিত হবে, কিন্তু চান্দ্রমাসের হিসেব সর্বত্র এক নয়, ফলে দেশভেদে উত্সবের দিন পালটে থাকে। এক মাসে দুটি পূর্ণিমা পড়লেও সমস্যা হয়। এ বার যেমন আমরা আজ, ৪ মে বুদ্ধপূর্ণিমা পালন করছি, কিন্তু তাইল্যান্ডে এটি পালিত হবে ১ জুন।
সিংহলিরা এ উত্সবের নাম বেশখ, নেপালে স্বানিয়া পুন্হি, মায়ানমারে কাসোন, তিব্বতে সাগা দাওয়া, ইন্দোনেশিয়ায় হরি রায়া ওয়াইসাক, মালেশিয়ায় হরি ওয়েসাক, খ্মেররা বলেন বিশক পূজা, তাইল্যান্ডে বিশাখ বুচা, ভিয়েতনামে ফট দন, লাওসে বিক্সাখা বোউক্সা। চিনে এর নানান নাম, যেমন ফো তান ও ইয়ু ফোচিয়ে। জাপানে হানা-মাত্সুরি। ছি খিয়ং থোং তাঁর ‘র্যাশনালাইজিং রিলিজন’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন, চিনারা কী ভাবে বুদ্ধ ও তাঁর অনুসারী আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে গ্রহণ করেছেন, কী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, কী কমিউনিস্ট ব্যবস্থায়, বিভিন্ন চিনা কমিউনিটি ‘ধর্মকে বজায় রেখেছেন ও সরল করে নিচ্ছেন’। জাপানে আবার সৌর ক্যালেন্ডারের ৮ এপ্রিল উত্সবটি পালিত হয়। জাপানি লোকবিশ্বাস, সে দিন এক ড্রাগন আকাশে আবির্ভূত হয়ে বুদ্ধকে সোমরস দিয়েছিল। প্রসঙ্গত, আজও জাপানে চল্লিশ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী।
বৌদ্ধধর্মের দেশগুলিতে বিশক-এর দিনে উপাসনালয়গুলিকে বর্ণাঢ্য ভাবে সাজানো হয়, সকাল থেকে মানুষ সেখানে আসেন, বৌদ্ধ পতাকা তুলে, বুদ্ধ, ধর্ম এবং সঙ্ঘের প্রতি শ্রদ্ধাসূচক সংগীতের মাধ্যমে উত্সবের সূচনা করা হয়। অনেক আমিষাশী দেশেও দিনটি সম্পূর্ণ মাছ-মাংসবর্জিত, দু’তিন দিন সমস্ত মদের দোকান বন্ধ থাকে। ভক্তরা হাজার হাজার পশু পাখি ও কীটপতঙ্গকে মুক্তি দেন।
শেষে আমার দেখা একটা আশ্চর্য বুদ্ধপূর্ণিমার কথা বলি। বর্ধমানে পূর্বস্থলী থানা এলাকায় জামালপুর নামে একটি গ্রাম আছে। সেখানে এই দিন ধর্মরাজের মন্দিরে চার পাশের নানা গ্রাম থেকে ভক্তরা জড়ো হন। হাজার হাজার ছাগল ও ভেড়া বলি দেওয়া হয়। তরবারি, বন্দুক ও অন্য নানা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে খেলাও হত, তবে সম্প্রতি পুলিশ সেটা বন্ধ করেছে। তবে এটা ব্যতিক্রমই। গোটা দুনিয়া যদি কোনও একটি দিনে হিংসার অবসানের জন্য প্রার্থনায় সমবেত হয়, তবে সেটা এই বুদ্ধপূর্ণিমাতেই।