এই ভয়াবহ মহামারির সময়ে আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম যে আমাদের মধ্যে এখন ধর্মের, জাতির ও ভাষার বিভাজন ভুলে একসঙ্গে মাঠে নামব। যারা এই সব ভাগাভাগি থেকে লাগাতার রাজনৈতিক সুবিধে খুঁজে বেড়ায়, তারাও এই যুদ্ধে শামিল হবে। ভেবেছিলাম, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামে যখন সম্পূর্ণ সমাজকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে, তখন অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ বা প্রকাশ করার অবকাশ থাকবে না। কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণা কাটতে বেশি সময় লাগেনি। প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় হুঁশিয়ারির পরের দিন থেকেই হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক ভরে গেল মুসলিম বিরোধী ছবি আর ভিডিয়োতে। উগ্র হিন্দুবাদীরা উঠেপড়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে ভারতবর্ষের মুসলিম পাড়ায় কী রকম বেপরোয়া ভাবে লকডাউন অমান্য করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষের মধ্যে বার বার ছড়ানো হল এই মনগড়া মিথ্যে ছবিগুলি।
এই পটভূমিকায় আমাদের একেবারেই আশ্চর্য হওয়া উচিত ছিল না, যখন দেখলাম, কী ভয়ঙ্কর উত্তেজনাপূর্ণ ভাবে দিল্লির নিজামুদ্দিনের তবলিগি জমায়েতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষ ছড়ানো হল। এই গোঁড়া মুসলমানদের সংগঠনটি যেন হিন্দু চরমপন্থীদের এক সুবর্ণ সুযোগ উপহার দিল। অসহনশীল হিন্দুরা ঠিক যে চিত্রটি ক্যারিকেচার করে তাদের বিদ্বেষ প্রচারে ব্যবহার করে, সেটাই এখন দেশের সব টিভি দর্শকেরা দেখল। কপিবুক উদাহরণে, ইসলাম মানেই এক অতি রক্ষণশীল ধৰ্ম, যার সব বিশ্বাসীরা লম্বা দাড়ি রাখেন, মাথায় ফেজ টুপি পরেন আর অঙ্গে আরব দেশীয় জোব্বা চাপান। শুরু হল তবলিগি ধর্মপ্রচারকদের ব্যঙ্গ, কুৎসা এবং তীব্র গালিগালাজ। মুসলমান মৌলবিদের তীব্র আক্রমণ শুরু করল দেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল, যারা সকাল সন্ধে প্রভুর জয়গান গায় আর সরকার-ভক্তিতে মগ্ন থাকে। আর তার সঙ্গে সরকারি প্রচার ও বিজ্ঞপ্তিতেও তবলিগি জমায়েতটিকে সরাসরি দোষারোপ করা হল এই করোনা রোগ আর মৃত্যু ছড়ানোর জন্যে। তখন সাধারণ মানুষের ঘৃণা এক চরম সীমায় পৌঁছেল। ঘটনাগুলি যেন একদম একটি স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী ঘটল।
কেউ অবশ্য একেবারেই অস্বীকার করতে পারে না যে এই তবলিগি মার্কেজ বা কেন্দ্র নিছক আক্কেলহীনতার পরিচয় দেখিয়েছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি তাদের অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ স্থানে পাঠানো উচিত ছিল। টিকিট না পাওয়ার গল্প কিছুটা সত্যি হলেও, বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, আসলে তারা ততটা উদ্যোগ দেখায়নি। আর এর জন্যে তারা নিশ্চয় দোষী।
কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয়টা হল, সাধারণ মুসলিমদের এর বোঝা বইতে হচ্ছে, যদিও তাঁরা ধর্মপ্রচার বা ধর্মান্তরে মোটেই বিশ্বাস করেন না। এবং অনেকেই মৌলবাদের ঘোরতর বিরোধী। এর সঙ্গে অবশ্য জড়িয়ে আছে আমাদের অন্য একটি শ্রেণিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বা শ্রেণিদ্বন্দ্ব। যখন করোনা আক্রান্ত মুসলিম তীর্থযাত্রীদের ইরান এবং আরব রাজ্যগুলি থেকে বিশেষ বিমানে ভারতে ফেরত আনতে হল, তখন ফিসফিস প্রচার চলেছে যে আমরা ওই মুসলিম দেশগুলি থেকে সংক্রমণ আমদানি করছি। কিন্তু যখন শিক্ষিত হিন্দু উচ্চ শ্রেণির যুবকেরা ব্রিটেন বা ইটালি থেকে দেশে ফেরে, আমরা তখন ধর্মের নামই তুলি না, কারণ তারা আমাদের শ্রেণির। এমনকি তারা যখন বন্ধুদের আর আহ্লাদি পরিবারকে নিয়ে ফুর্তি করে সারা শহরে ভাইরাস ছড়িয়ে বেড়ায়, তখনও আমরা কেমন যেন অন্য চোখে দেখি।
চার দশকের বেশি প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকার সুবাদে আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে। এই বিশাল এক ধর্মপ্রচারকদের মিলন মেলায়, যেখানে বিদেশ থেকে প্রচুর সংখ্যায় চিহ্নিত মুসলিম চরমপন্থীরা আগত হয়েছিল, সেখানে গোয়েন্দা পুলিশের ভূমিকা ঠিক কী ছিল? শেষে তো ভারতের পুলিশ ও গুপ্তচর-গোয়েন্দাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক অজিত ডোভালকেই স্বয়ং যেতে হল এলাকায় গভীর রাতে। এটা নিশ্চয় প্রশংসনীয়, কিন্তু যদি সবই জানা ছিল, তবে দশ-বারো দিন আগে হস্তক্ষেপ করলে বোধহয় অনেক অবাধ্য ও জেদি লোকের প্রাণ রক্ষা করা যেত। আমরা এটাও জানি যে বহিরাগত মৌলবাদীদের কিন্তু ভারত সরকারই আগমনের ভিসা দিয়েছে। এখন অবশ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রভুরা দাবি করছেন, এই সব মৌলবিরা পর্যটক ভিসার ফাঁকে এই দেশে ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু কম্পিউটারের যুগে সুরক্ষায় এত বড় ফাটল থাকা তো উচিত নয়।
আরও দেখা গেল, একই প্রশাসনের অধীনে অভিবাসন বা ইমিগ্রেশনের নজর এড়িয়ে দিব্যি সকলে বেড়িয়ে বেড়ায়। অমিত শাহের সচিবালয় সারা দিন প্রতিটি রাজ্যের ওপর করোনা প্রতিরোধের নামে ছড়ি ঘোরান। সঙ্গে এই সব গুরুতর বিষয়েও একটু সময় দিলে ভাল হত। এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রধান যদি জাতির স্বার্থে মাঝে মাঝে কিছু নিরপেক্ষ বিবৃতি দেন, তবে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল বা অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের বিষাক্ত আবহাওয়াটাকে একটু দূষণমুক্ত করা যায়। অবশ্য মোদী ও অমিত শাহ সম্পূর্ণ মুসলমান জাতিকে দোষী করার এই লোভনীয় সুযোগ ছাড়বেন কি না, সন্দেহ আছে।
আমরা যখন তবলিগির কর্তাদের বেপরোয়া আচরণের নিঃসন্দেহে ধিক্কার জানাচ্ছি, তখন কেউ কিন্তু এক বারও প্রশ্ন তুলছি না, ঠিক ওই সম্মেলনের সময় সারা দেশে অন্যান্য ধর্মের সভা বা উৎসব বহাল তবিয়তে চলার ব্যাপারে। যেমন একই সময়ে হিন্দু মহাসভার নেতা ও সদস্যরা বেশ কয়েকটি জায়গায় হাজার লোকেদের একত্রিত করে একসঙ্গে গোমূত্র পান করেছিল। আর তিরুপতি সহ প্রচুর হিন্দু ধর্মস্থানে অগণ্য তীর্থযাত্রী ছিলেন বা আটকে পড়েছিলেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকঢোল বাজিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে রামলালার মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠান করলেন অযোধ্যায়। পঞ্জাবের নাওয়ান শহরে শিখদের বিশাল ধার্মিক মেলায় সদ্য ইউরোপ ফেরত বিখ্যাত গ্রন্থি বলদেব সিংহ নির্বিচারে করোনাভাইরাস ছড়ান এবং তার পর নিজেই মারা যান। সত্যি বলতে, মার্চের প্রথম তিন সপ্তাহে সাধারণ মানুষ আর দেশের সর্বোচ্চ নেতাও এই সংক্রমণকে পুরোপুরি উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি। রাজ্য স্তরে কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ এই মৃত্যুবহনকারী রোগের ব্যাপারে সচেতনতা বিস্তার ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার বেশ কয়েক দিন পরে প্রধানমন্ত্রী জেগে উঠলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয় নিষেধাজ্ঞা আর অন্যান্য আদেশ দিলেন।
আমাদের অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে যে সংক্রমণের সঙ্গে জাতি বা ধর্ম ভিত্তিক উন্মাদনার এক গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। যেমন দেখা যাক প্লেগ বা কালো মৃত্যুর ইতিহাস। এক সহস্রাব্দ ধরে যত বার ইউরোপকে এই মহামারি আক্রমণ করে আর লক্ষ লক্ষ লোককে মারে, তত বার ‘দি আদার’ বা ‘সমাজের শত্রু’ হিসেবে কোনও না কোনও গোষ্ঠীকে খাড়া করা হয়। তার পর শুরু হয় মারধর আর খুনের তাণ্ডব। ইহুদিদের সবচেয়ে বেশি অত্যাচার ও গণহত্যার শিকার হতে হয়েছে। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আর তার পর রোমা বা ভারত থেকে আগত যাযাবর জিপসি জাতিদের। সিসিলিতে সব কাতালোনিয়ার (Catalonian) মানুষদের খুন করা হয়। এই প্রকার সহস্র উদাহরণ আছে। যুগ যুগ ধরে আমরা দেখেছি, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় মানুষ এবং সমাজ মৌলিক বিচারশক্তি হারিয়ে এক মারাত্মক জ়েনোফোবিয়া-য় আক্রান্ত হয়। অন্য জাতি ধৰ্ম বা গোষ্ঠীকে দোষী করে এবং সংক্রামক ব্যাধির নামেই তার প্রকাশ পায়। বিগত শতাব্দীতে আমরা দেখেছি, কী করে মৃত্যুবাহক রোগের নামে কত দেশ বা জাতিকে দোষী করা হয়। যেমন স্প্যানিশ ফ্লু, ফ্রেঞ্চ পক্স, রাশিয়ান রোগ, এশিয়াটিক কলেরা, কঙ্গোর ইবোলা, মেক্সিকান ফ্লু, চিনের মহামারি ইত্যাদি অনেক দৃষ্টান্তের কথা বলা যায়।
এ বারও ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যস্ত হয়েছেন করোনাকে চিনের উহান সংক্রামক ব্যাধি বলে মার্কা মারার জন্যে। তাতে অবশ্য তিনি ভোট বেশি পাবেন না। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করলে আর কুৎসা ছড়ালে প্রচুর লাভ।
আমরা এই সুযোগে নরেন্দ্র মোদীকে এক বার মনে করাতে চাই, অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে রাজধর্মের দায়িত্বের কথা শিখিয়েছিলেন। অতএব মোদী যদি তাঁর অফুরন্ত বাণীর মাঝে মাঝে উল্লেখ করেন যে এই মহামারির সঙ্গে কোনও ধর্ম বা জাতির সম্পর্ক নেই, তবে তিনি সত্যি রাজধর্ম পালন করবেন। তা হলে আজকের এই পরিকল্পিত ও উৎপাদিত ঘৃণার কিছুটা মোকাবিলা করা যাবে।