প্রধানমন্ত্রীর ‘গোসা হওয়ার কারণে’ মুখ্যসচিবকে এ ভাবে জেলে পোরার ‘হুমকির’ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট, এমন শিশুসুলভ মানসিকতাও এখন দেশে প্রশাসনিক নীতির অঙ্গ।
রাজ্যের সদ্য অবসর নেওয়া মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘শো-কজ়’ (কারণ দর্শানোর) নোটিস পাঠিয়েছে কেন্দ্র। তাতে সই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারির। কিন্তু বলতেই হচ্ছে, ওই চিঠির খসড়া যথেষ্ট ‘দুর্বল’। ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ নম্বর ধারায় তা পাঠানো হয়েছে। তারিখ ৩১মে, যাতে বোঝা যায় যে, আলাপনের অবসরের আগেই তা তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। বলা বাহুল্য ওই নোটিস দেওয়া হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ কর্মিবর্গ দফতর আলাপনকে ‘বাগে আনতে না-পারার’ পরে।
আমলাতন্ত্রের চেনা ভাষায় আলাপনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কেন ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ নম্বর ধারায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে না? যাতে কিনা দু’বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে! উত্তর দিতে সময় দেওয়া হয়েছে তিন দিন। প্রধানমন্ত্রীর ‘গোসা হওয়ার কারণে’ মুখ্যসচিবকে এ ভাবে জেলে পোরার ‘হুমকির’ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট, এমন শিশুসুলভ মানসিকতাও এখন দেশে প্রশাসনিক নীতির অঙ্গ। ভারতের ইতিহাসে এর আগে কোনও প্রধানমন্ত্রী এ ভাবে অপরিসীম ঔদ্ধত্য খোলাখুলি ভাবে প্রকাশের কথা ভাবতেও পারেননি।
দেখা যাক, কী কী দোষে আলাপনকে দোষী করা হয়েছে। আমার ধারণা, এতে যে আখেরে প্রধানমন্ত্রীকেই হাস্যকর দেখাবে, সে কথা আর সাহস করে তাঁর মন্ত্রকের অফিসারেরা বলে উঠতে পারেননি।
প্রথম অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীকে পাক্কা ১৫ মিনিট অপেক্ষা করানোর ‘দুঃসাহস’ দেখিয়েছেন আলাপন ও তাঁর মুখ্যমন্ত্রী। জানতে ইচ্ছে করে, তাতে মাথায় কতখানি আকাশ ভেঙে পড়েছিল? সম্ভবত দেরিও ওই আকাশের কারণে। ৩১ মে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত সাগরদ্বীপ থেকে তাঁর এবং মুখ্যসচিবের হেলিকপ্টারে রওনা দিতে ‘দেরি হয়েছিল’। কারণ, আকাশপথে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে তার অনুমতি এসেছিল দেরিতে। এই চিঠির কোনও বিরোধিতা প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর আজ্ঞাবহরা করেননি। আইনের চোখে যার অর্থ, চিঠির প্রাপক ওই যুক্তি মেনে নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক হয়তো এ বার ওই ১৫ মিনিট দেরির ‘অমার্জনীয় অপরাধের’ জন্য এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার সমেত সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় কর্মীদের শাস্তি দেবে অথবা সাসপেন্ড করবে। আলাপন বিমান বা হেলিকপ্টার ওড়াতে জানেন না (আইএএসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘোড়ায় চড়া অবশ্য রপ্ত করতে হয়েছিল)। নইলে নিজে হেলিকপ্টার চালিয়ে চলে আসার রাস্তা হয়তো তাঁর সামনে খোলা থাকত!
কলাইকুন্ডা বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক নির্ধারিত ছিল দুপুর আড়াইটেয়। মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিক ক্ষণ আগেই আলোচনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এখন যে ‘গুরুতর অপরাধে’ আলাপনকে জেলে ভরার কথা বলা হচ্ছে, তা হল, প্রধানমন্ত্রীর বিমান কলাইকুন্ডার মাটি ছোঁয়ার আগে থেকে হাতে ফুলের তোড়া, মুখে হাসি আর ‘নত হয়ে’ স্যালুট ঠোকার প্রস্তুতি সমেত তিনি উপস্থিত ছিলেন না। ফলে অভিযোগ নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক দেরি করিয়ে দেওয়ার নয়। বেচারা আন্ডার সেক্রেটারিকে কেউ বোধ হয় এ কথা বলেননি। কলাইকুন্ডা ঠিক কোথায়, তা-ও সম্ভবত তাঁর অজানা।
সুতরাং, ভিআইপি অভ্যাগতকে বরণ করতে না-পারার ‘অপরাধে’ জেলে পাঠানোর জন্য ফৌজদারি আইন যতক্ষণ সংশোধন করা না-হচ্ছে, ততক্ষণ কাউকেই এর জন্য অভিযুক্ত করা শক্ত। মনস্তত্ত্ববিদেরা বলতে পারেন, এই ঘটনা শুধু হাস্যকর নয়, বরং এতে কোথাও একটা ‘ভয়ঙ্কর পাগলামির’ ছাপ আছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, দেশের কর্ণধার পশ্চিমবঙ্গ এবং তার সংলগ্ন রাজ্যে আসার কথা জানানোর আগেই তিনি আকাশপথে ও ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় পৌঁছে ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখার দিনক্ষণ, সময়সূচি ঠিক করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি ঘোষণার পরে তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তিনি তা পরিবর্তন করেছেন। একমাত্র এ যুক্তরাষ্ট্রে মার্শাল-আইন জারি না-হলে, এই কথাগুলি আগাম জানিয়ে রাখাই প্রধানমন্ত্রীকে অপেক্ষা করিয়ে না-রাখার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট। আর আলাপনের সূচি যেহেতু তাঁর ‘বসের’ দিনভরের কার্যক্রমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত, তাই উপরের এই প্রমাণ সম্ভবত তাঁর পক্ষেও যথেষ্ট।
যদি অটলবিহারী বাজপেয়ী কিংবা মনমোহন সিংহের মতো একটু ‘ভিন্ন ভাবে শিক্ষিত’ প্রধানমন্ত্রীর সময়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো, সে ক্ষেত্রে হয়তো তিনি নিজেই মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করতেন। ডেকে নিতেন নিজের বিমানে। যাতে এক সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখা যায়। কিন্তু যাঁরা ‘অজ্ঞাত রেলস্টেশনে চা বিক্রি করে আসা’ শৈশবের গর্ব করেন কিংবা পরিচয় দেন ‘ফকির’ হিসেবে, তাঁদের কাজের ধরন সম্ভবত অনেকটাই আলাদা।
আলাপনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে অনুপস্থিত থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা অথরিটির চেয়ারম্যান। বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ নম্বর ধারা তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাঁরা কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া এই আইন অমান্য করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই আজ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতন্ত্রের কালো দিন যে, এই ধারায় এক মুখ্যসচিবকে কারও ‘ইগো-ম্যাসাজের’ বদলে মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তিগ্রাহ্য আদেশ পালনের জন্য কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে! তা-ও বিপর্যয়ের ঘোর বিপদের সময়ে। এই ধারায় তাঁকে শাস্তি দেওয়া যায়, যিনি কোনও অফিসার, কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের নিয়োগকর্তাদের নির্দেশ অবমাননা করেছেন। কেন্দ্র অথবা রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলার দায়িত্ব যাঁকে দিয়েছে, তাঁর কথা না-মানলেও তা-ই। কিন্তু এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা অথরিটির চেয়ারপার্সন। আর মুখ্যসচিব ওই আইনের ২০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সেই অথরিটির এগ্জিকিউটিভ কমিটির চেয়ারপার্সন। তাঁরা বড়ানগর কিংবা কাঁচরাপাড়ার রাস্তায় উস্কোখুস্কো চুল আর অবিন্যস্ত পোশাকের শিশু নন। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা অথরিটির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা পর্যালোচনা বৈঠকে শুধুমাত্র অনুপস্থিত থাকার কারণে তাই তাঁদের নিজের রাজ্যের বিরোধী ঠাওরে নেওয়া আরও হাস্যকর। প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি দেখতে কয়েক ঘণ্টার জন্য সেখানে উড়ে এসেছিলেন। বৈঠকে এমন ‘ভিআইপিরাও’ ছিলেন, যাঁরা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত নন।
আগে দেখাতে হবে, তাঁর কোন আদেশ রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা অথরিটির চেয়ারপার্সন কিংবা এগ্জিকিউটিভ কমিটির চেয়ারপার্সন অমান্য করেছেন? সেই লিখিত আদেশ কোথায়? এত ব্যস্ত মানুষদের নিশ্চয় ‘টেলিপ্যাথি’ মারফত সব কিছু বুঝে ফেলার সময় নেই।
যে ‘ক্লজ-১বি’ অনুযায়ী আলাপনকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে, তা তাঁদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যাঁরা কেন্দ্র, রাজ্য, জাতীয় কিংবা রাজ্য স্তরের এগ্জিকিউটিভ কমিটির জারি করা কিংবা তাঁদের তরফে দেওয়া নির্দেশ অমান্য করেছেন। একমাত্র সে ক্ষেত্রেই দোষী সাব্যস্ত হলে, এক-দু’বছরের জন্য জেলে যাওয়া অথবা জরিমানা গোনার প্রশ্ন। এখন এই আইনকে হাতিয়ার করে নরেন্দ্র মোদী যখন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে নতুন করে আঘাত হানতেই চান, তখন আগে দেখাতে হবে, তাঁর কোন আদেশ রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা অথরিটির চেয়ারপার্সন কিংবা এগ্জিকিউটিভ কমিটির চেয়ারপার্সন অমান্য করেছেন? সেই লিখিত আদেশ কোথায়? এত ব্যস্ত মানুষদের নিশ্চয় ‘টেলিপ্যাথি’ মারফত সব কিছু বুঝে ফেলার সময় নেই। আর সরকারি প্রশাসনে সমস্ত নির্দেশ লিখিত। যাতে তা দেওয়া এবং না-মানার প্রমাণ থাকে। রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে লিখিত ভাবে এ ভাবে কাঠগড়ায় তোলা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রবল আঘাত। শুধু ‘পরাজয় মানতে না-পারার’ কথা বলে একে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা ভাল। মুখ্যমন্ত্রী গোড়া থেকেই আলোচনায় শুভেন্দু অধিকারীকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। দরবার নয়, গভীর আলোচনার জন্য বৈঠক চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে। তাঁর সেই অধিকার রয়েছে। কারণ, দিনের শেষে চূড়ান্ত দায় তাঁরই। তাঁকে কিন্তু তাঁর মন্ত্রী কিংবা দলের নেতাদের সঙ্গে আনতে দেওয়া হয়নি। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও সমস্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আসা ভিআইপিদের অনেকের থেকেই সম্ভবত তাঁরা বেশি অবগত। আর প্রধানমন্ত্রী যদি বিরোধী দলনেতাকে আমন্ত্রণ জানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থেকেই থাকেন, তাহলে জানতে ইচ্ছে হয়, কেন্দ্রে বিভিন্ন পর্যালোচনা বৈঠকে তিনি ক’বার অধীর চৌধুরীকে ডেকেছেন? যাঁকে বিরোধী দলনেতা হিসেবে নিজেই সম্বোধন করেন তিনি।
আর একটি বিষয় হল, মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, মুখ্যসচিব তাঁর সঙ্গে দুর্গত এলাকায় যান। যাতে মুখ্যমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ নোটবুকে তুলে নিতে পারেন। দিঘায় রওনা দেওয়ার আগে নিজের এবং মুখ্যসচিবের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্পষ্ট অনুমতি নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদি প্রধানমন্ত্রী মুখ্যসচিবকে বৈঠকে চেয়ে থাকেন, তবে তো তা আগেই জানানো যেত। নিদেন পক্ষে তখনই তা বলতে পারতেন তিনি। প্রথমে নীরব থেকে পরে অকারণে শাস্তি সরকারি নীতিতে কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। আর সম্পূর্ণ অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের নতুন মাইলফলক গড়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, এ বার তবে না হয় খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই ‘শো-কজ’ করুন তিনি!