একটাই বিপর্যয়ে সমস্ত অঞ্চলের সমস্ত বর্গের ভারতবাসী বিপন্ন— এমন ঘটনা আমাদের গোটা ইতিহাসে এই প্রথম ঘটল। কোনও যুদ্ধেরই এমন প্রভাব পড়েনি। এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেরও নয়। চিনের সঙ্গে এক বার, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিন তিন বার, তাতেও নয়। সব যুদ্ধই লড়েছেন সৈনিকরা, রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে। দেশের সর্বত্র সবাইকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে, এমনটা এই প্রথম। করোনা মৃত্যুতে গণতন্ত্র এনেছে, মর্যাদা কিংবা ক্ষমতা, কাউকেই সে পাত্তা দেয়নি। শুধু এ দেশে নয়, দুনিয়া জুড়ে। ফলে আমাদের আতঙ্ক একেবারে সর্বগ্রাসী। এই বিপদের মোকাবিলায় আমাদের তাই ঐক্য চাই, চাই দৃঢ় প্রত্যয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে এখনও তার দেখা মিলছে না। এই বিষয়ে একসঙ্গে কথা বলতেই জি-২০ গোষ্ঠীর দেশগুলি অনেক সময় নিয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই দু’বার টেলিভিশনের পর্দায় নাটকীয় ভাবে অবতীর্ণ হয়ে দেশবাসীকে বলেছেন নিজেদের যার যার ঘরে বন্দি করে রাখতে। তাঁর দেশের নাগরিকদের অনেকেরই শৃঙ্খলাবোধ বিশেষ দেখা যায় না, অথচ অতি-সংক্রামক নোভেল করোনাভাইরাসের অভিযান ঠেকানোর জন্য মানুষকে পরস্পরের থেকে দূরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। অতএব প্রথমে জনতা কার্ফু, তার পরে একুশ দিনের ঘরবন্দি। রাজ্য পুলিশের লাঠি রাস্তায় রাস্তায় মানুষকে এই ঘরে থাকার বার্তাটি ভাল রকম বুঝিয়ে দিয়েছে— যাঁদের শাস্তি প্রাপ্য ছিল এবং যাঁদের ছিল না, তাঁদের মধ্যে বাছবিচার না করেই পুলিশ নির্বিচারে লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, আমাদের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে এতটা সময় লাগল কেন? জানুয়ারি মাসেই চিনে কোভিড-১৯’এর দাপটে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। ৩০ জানুয়ারি তারিখেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এই মারিকে ‘আন্তর্জাতিক ভাবে উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত আপৎকালীন পরিস্থিতি’ (পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন’) বলে ঘোষণা করেছিল। হু তো প্রতি সপ্তাহে ভারতকে সতর্ক করে এসেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মন নানা ব্যাপারে ব্যস্ত থাকে, তাঁর উপদেষ্টা ও আধিকারিকরা হয়তো তাঁকে পরিস্থিতির গুরুত্ব ঠিকঠাক বোঝাতে পারেননি। দিল্লীশ্বররা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে সংক্রমণের মোকাবিলায় নামেননি। এমনকি পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করার ব্যাপারেও তাঁরা গড়িমসি করেছেন, অথচ এই বস্তুটি কোনও উচ্চ প্রযুক্তির ব্যাপারই নয়। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদী যখন করোনার বিরুদ্ধে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ করার কথা বলছেন, তাঁর সরকার তখন যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সত্যিকারের লড়াইটা করছেন তাঁদের যথেষ্ট সুরক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্তটুকুও করে উঠতে পারেননি। ফলে দেশের প্রায় সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি প্রচণ্ড সঙ্কটের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এখনও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সরবরাহে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় রকমের ঘাটতি আছে।
ঘটনা হল, ২২ মার্চ বেলা পাঁচ ঘটিকায় আমরা যখন আগমার্কা হিন্দু মতে শাঁখ, কাঁসর ঘণ্টা, থালাবাটি বাজাচ্ছি, দেশের সর্বত্র ডাক্তাররা তখন আরও টেস্টিং কিট অর্থাৎ শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষার সরঞ্জামের দাবিতে মুখর। এই কিটগুলি সংগ্রহ করার ব্যাপারে যে বিলম্ব ঘটেছে, তা একটা বিরাট কেলেঙ্কারির শামিল। এই বিলম্বের কারণেই ভারতে যথেষ্ট পরীক্ষা করা যায়নি, তার ফলে সম্ভবত সংক্রমণের পরিসংখ্যান প্রকৃত অবস্থার তুলনায় কম দেখাচ্ছে, একটা ভুল নিশ্চিন্ততার বোধ তৈরি হচ্ছে। আমরা কেবল এইটুকু প্রার্থনা করতে পারি যে, সংক্রমণের সংখ্যায় হঠাৎ এমন কোনও বিস্ফোরণ ঘটবে না যাতে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়— আমাদের হাসপাতালে যথেষ্ট শয্যা নেই, ভেন্টিলেটরেরও ঘাটতি। বড় সংখ্যায় মানুষকে সরিয়ে নিয়ে বিচ্ছিন্ন করতে হলে সরকারি ইমারতে সে জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা দরকার, দরকার যথেষ্ট অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা মজুত রাখা।
আমরা এটাও এখন জানি যে, কেবল বিশেষজ্ঞরা নন, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের মুখ্যমন্ত্রীরাও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশেষ তৎপরতা দেখিয়েছিলেন। পথে নেমে লড়াইয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যোগী আদিত্যনাথের মতো মুখ্যমন্ত্রীরা যখন প্রতিবাদীদের পেটাতে এবং অযোধ্যায় অস্থায়ী মন্দির বানিয়ে রামলালাকে অধিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত, মমতা তখন নিজের অভিজ্ঞতাকে হাতিয়ার করে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যে ভাবে তিনি প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে নিজে গিয়ে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বাড়িয়েছেন এবং সমস্ত বন্দোবস্তের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করেছেন, তার মূল্য অনস্বীকার্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সমালোচক হয়েও এই ‘দাঁড়িয়ে থেকে’ নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতায় চমৎকৃত হতেই হয়। দোকানে জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে খরিদ্দারদের কী ভাবে দাঁড়ানো উচিত, সেটা বোঝাতে তিনি এমনকি নিজে হাতে রাস্তায় খড়ির গণ্ডি টেনে দেখিয়েছেন। সঙ্কটের মোকাবিলায় তাঁর নির্দেশ ও পরামর্শ এই কারণেই বিশেষ মূল্যবান— অনেক মুখ্যমন্ত্রী বা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া খবরাখবরের ভিত্তিতে নীতিকর্তব্য স্থির করছেন, তিনি তখন একেবারে রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের কৌশল ঠিক করছেন। আর, নিরন্তর কোটি কোটি ক্যামেরার সামনে থাকার এই যুগে অষ্টপ্রহর মানুষ নেতানেত্রীদের যে আচরণ দেখেন, তা দিয়েই তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই হয়ে চলে। তা ছাড়া আর একটা লড়াইও তো এ-সবের পাশাপাশি লড়তে হচ্ছে এখন। তার নাম হোয়টসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি। সেখানে প্রত্যেকে এমবিবিএস, প্রত্যেকে করোনা-বিশেষজ্ঞ। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবর্জনা ভাইরাসের চেয়েও দ্রুত ভাইরাল হয়ে চলেছে, তার মোকাবিলাও সহজ কাজ নয়।
শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নিজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজ্য প্রশাসন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। ভাল। পশ্চিমবঙ্গের মতো কয়েকটি রাজ্যের পদক্ষেপ থেকে অনেকেই অনেক কিছু শিখছে। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারও। ভারতের অর্থমন্ত্রী যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তার নানা ব্যাপার টুকে দেওয়া হয়েছে কিছু রাজ্যের উদ্যোগী মুখ্যমন্ত্রীদের সীমিত সামর্থ্যে গৃহীত কর্মসূচি থেকে। যেমন, এই অতিমারির বিরুদ্ধে যে স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়াই করছেন, তাঁদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিমা চালু করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার পরে কেবল বিমার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। তেমনই, দরিদ্র, অসংগঠিত উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট যে মানুষদের কাজ নেই, খাদ্য নেই, যাঁরা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন, তাঁদের জন্য বিনা মূল্যে এবং ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য সরবরাহের যে প্রকল্প কেন্দ্র ঘোষণা করেছে, তা এই রাজ্যের সরকার আগেই চালু করেছিল। এই প্রকল্প খুবই প্রয়োজনীয় এবং স্বাভাবিক, কারণ দেশের ভাঁড়ারে প্রায় ৫ কোটি মেট্রিক টন চাল এবং ৩ কোটি মেট্রিক টন গম মজুত আছে, যা দিয়ে গোটা দেশকে এক বছরের বেশি অন্তত ভাত-রুটিটা খাওয়ানো যায়, যদিও শস্যের গুণমান এবং তার বণ্টনের ব্যবস্থা, দুটো নিয়েই সমস্যা আছে।
যে বিপর্যয় সংক্রান্ত আইন কাজে লাগিয়ে রাজ্যগুলিকে আগে থেকে কিচ্ছু না জানিয়ে কেন্দ্র ২৫ মার্চ দেশব্যাপী একুশ দিনের ঘরবন্দির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, সেই আইনবলে তার আগেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিপর্যয় ত্রাণ তহবিল তৈরি করে ফেলেছিল। এটা বিস্ময়কর যে, দিল্লির শাসকরা বুঝতে পারেননি, এই আকস্মিক ঘরবন্দির ফলে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক আতান্তরে পড়ে সম্পূর্ণ অসহায় ভাবে নিজের নিজের রাজ্যে ফিরতে বাধ্য হবেন, অথচ রাজ্যগুলি অনেকেই এ ব্যাপারে তাঁদের সাবধান করেছিল। মমতাই প্রথম বলেছিলেন, অভিবাসীরা এই ভাবে দল বেঁধে ঘরে ফেরার ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়বে, বাড়বে ব্যাধি ও মৃত্যু, তাই এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার। যে সব অভিবাসী শ্রমিক ও কর্মী এখনও অন্য রাজ্যে আটকে আছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থাটুকু করে দিলে তাঁর প্রতি দেশের মানুষের ভক্তি আরও বাড়বে। এবং যে সব রাজ্য এই বিপদের সঙ্গে লড়াইটা চালাচ্ছে, ক্ষুদ্র রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে এখনই তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দও করা দরকার।
আমরা কী ভাবে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করব, সেটাই দেখিয়ে দেবে, এমন বিপর্যয়ের সঙ্গে ঠিক ভাবে লড়াই করে নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ্য জাতিগত ভাবে আমাদের আছে কি না, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ তার উপযোগী কি না। যে সব দেশ যুদ্ধ, মড়ক এবং অন্য নানা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তাদের জাতীয় চরিত্রে ‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার’ শক্তি জন্ম নিয়েছে। ভারতের এমন অগ্নিপরীক্ষা এই প্রথম।