জানি না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জুলিয়াস সিজ়ারের সেই বিখ্যাত তিনটি কথা ‘ভেনি ভিডি ভিচি’, যার অর্থ ‘আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম!’ শুনেছেন কি না। তাঁর কলকাতার ঝাঁকিদর্শনের শেষে মনে হয় মাথায় এই উক্তিটিই ঘুরছিল। যদিও গণতন্ত্রে জয়-পরাজয়ের ব্যাপারটা সিজ়ারদের হাত থেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ে নিয়েছেন ভোটাররা। নির্বাচনের আগে কলকাতা এসে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর উদ্যাপন উদ্বোধন করে বাংলার মানুষের হৃদয়ে পৌঁছবার এই গরম গরম তৎকালের টিকিট তিনি ছাড়বার পাত্র নন।
প্রথম অনুষ্ঠান নেতাজির এলগিন রোডের বাড়িতে, সেখানে খুব একটা রাজনীতি করার সুযোগ পাননি তিনি। কেননা ওই পরিবার তিন পুরুষ ধরে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ। তাঁকে খুব সামলে চলতে হয়েছিল। তার পরে তাড়াহুড়ো করে গেলেন জাতীয় গ্রন্থাগারে। তাঁকে কে বা কারা বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু ওই ভাবে চটজলদি তৈরি করা একটি নেতাজির মূর্তি মাঠের মাঝে উন্মোচন করলেই এই রাজ্যের নির্বাচকেরা দারুণ প্রভাবিত হবেন বলে মনে হয় না। তাও আবার সস্তার ফাইবারগ্লাসের ভাস্কর্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কত মূর্তি কলকাতা দেখেছে, নামিয়েছে, সরিয়েছে, তুলেছে— তার হিসেব নেই। জাতীয় গ্রন্থাগারে একটি ‘আন্তর্জাতিক আলোচনা’য় প্রধানমন্ত্রী কয়েক মুহূর্তের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আলোচনা কী, কাদের নিয়ে, কিছু জানা গেল না। অনুষ্ঠানে সংবাদমাধ্যমেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
এর পর গন্তব্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সেখানে অনেকেই ভয়ে ভয়ে ছিলেন, এই না পরিচিত নামটা বদলে দেন। নেতাজির পরিবারের কেউ কেউ আপত্তি জানাবার পর বোধ হয় সুবুদ্ধির উদয় হল। নাম বদলাবার চেষ্টা করেননি তিনি। সাম্রাজ্যবাদ এবং তার বিরোধিতার বিষয়টি আর একটু বিশদে আলোচ্য, কিন্তু আমাদের মনে রাখা ভাল যে, এই অট্টালিকাটি সম্পূর্ণ ভারতীয়দের অর্থে সৃষ্টি হয়েছে, ব্রিটেন থেকে একটা পয়সাও আসেনি। এই সুপরিচিত স্থাপত্যের সাইনবোর্ড না বদলে নেতাজির সম্মানে একটি নতুন স্মৃতিসৌধের প্রকল্পের ঘোষণা করলে রাজ্যের লাভ হত। কিন্তু নামকরণ নিয়ে আরও একটি বিষয়ে গোলমাল সৃষ্টি করলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় সুভাষকে তো ‘দেশনায়ক’ বলে ডেকেছিলেন। এই অভিধেয়টি বাংলার সকলেই গ্রহণ করলেও কেন্দ্রের একতরফা ভাবে জাতীয় উদ্যাপনের নামে ‘পরাক্রম’ যুক্ত করলেন। রাজ্য কিন্তু মানছে না। মনে হয় আবার শুরু হল সেই দ্বন্দ্ব— ‘আমাদের দোল ওদের হোলি’ বা ‘আমাদের কালীপূজা ওদের দেওয়ালি’। এর পর শুনব ‘আমাদের দেশপ্রেম ওদের পরাক্রম’।
বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বা অনুরক্তি না বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়লে যে কত বিপদ। কয়েক সপ্তাহ আগে ওঁদের নেতা অমিত শাহ শান্তিনিকেতনে হঠাৎ গুরুদেবের পবিত্র আসনে বসে পড়লেন। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য তাঁকে বিনম্র ভঙ্গিতে পরিদর্শন করাচ্ছিলেন, তিনি তো এই বিষয়টির সংবেদনশীলতার কথা এক বার বলতে পারতেন। সংবাদে পড়ছি যে, তিনি তো দুনিয়ার সকলের উপর সব ব্যাপারে গর্জনব্যস্ত, আর শক্তি প্রদর্শনে প্রায় অনুব্রত মণ্ডলের সমকক্ষ। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ তথ্য কেন? রবীন্দ্রনাথ নাকি শান্তিনিকেতনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য নাকি কাটোয়ার কোন এক মন্দিরে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিরসা মুন্ডার নামে অন্য একটি প্রতিমূর্তি মাল্যভূষিত হল। এমন আরও কত কী। সকলেই জানে যে, বাংলায় এই রাজনৈতিক দলের খুব উচ্চশিক্ষিত সমর্থকের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। দিল্লির এক প্রভাবশালী প্রবাসী বাঙালি সাংসদকে তাই এই সব ব্যাপারে জড়াতে হয়।
তাঁর সঙ্গে এ বার কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব বেশ কয়েক দিন ধরে এই মেমোরিয়ালেই তাঁদের সদর দফতর বসিয়েছিলেন। আর এই শহরের বেশ কিছু নির্বাচিত বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক দুনিয়ার লোকেদের তলব করতেন, উপদেশ দিতেন আর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেন।
কিন্তু এত সত্ত্বেও আবার একটি বিতর্ক সৃষ্টি হল। অনেকেই অবাক হলেন যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উচ্চসুরক্ষিত প্রাঙ্গণে যেখানে খুব বেছে বেছে আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে এত ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলার ভক্ত কী করে পৌঁছে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বা উপস্থিত কর্তৃপক্ষের কেউই কেন তাঁদের বাধা দিলেন না। আসল কথা নিশ্চয়ই তাঁরা জানেন ইতিমধ্যে— নেতাজির ঐতিহ্য আর সঙ্ঘের চিন্তা বা কার্যকলাপের মধ্যে বরাবরই আকাশপাতাল তফাত। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দীর্ঘ ভাষণে অন্তত দু’বার উল্লেখ করেছিলেন নেতাজি কত ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু এক বারও বললেন না যে, এটা ছিল তাঁর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিশ্বাস। তিনি কখনও রাজনীতিতে নিজের ধর্ম মিশিয়ে ফেলেননি, বরং ধর্মপরিচয়ের উপরে ওঠার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতেন। ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন নেতাজি ঘোষণা করেছিলেন তাঁর দলে হিন্দু এবং মুসলমান চরমপন্থীদের কোনও স্থান নেই। আর কেউ কংগ্রেসে থাকাকালীন সঙ্গে মুসলিম লীগ বা হিন্দু মহাসভার সদস্য হতে পারবেন না। মোদী এক বারও উল্লেখ করলেন না যে, তাঁর পরম গুরু এবং হিন্দুত্ব আদর্শের প্রবর্তক দামোদর সাভারকরের অতি সঙ্কীর্ণতার বিষয়ে নেতাজির বিশেষ আপত্তি ছিল। সরাসরি সাভারকরের বিরোধিতা করেছিলেন। সুভাষ তাঁর ভারতের সংগ্রাম বইয়ে তীক্ষ্ণ ভাষায় সাভারকরের উগ্র হিন্দুবাদকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি।
নেতাজি যখন দেশ ছেড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ঐতিহাসিক যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, ঠিক সেই সময় সাভারকর আর তাঁর হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশ শক্তিকে মজবুত করার আবেদন করলেন। সাভারকর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে প্রচুর ভারতীয় নিয়োগ করার জন্যে উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁর বক্তৃতা আর লেখাতে এর যথেষ্ট প্রমাণ আছে, যার মধ্যে আমরা উল্লেখ করতে পারি ১৯৬৩ সালে পুণে থেকে প্রকাশিত ‘সাভারকর সমগ্র’। আশা করি, নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে এই বিশ্বাসঘাতকতার সত্য তুলে ধরা যাবে। আজকের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে মনে রাখা উচিত যে, নেতাজি সব সময় সকলকে একসঙ্গে নিয়ে চলতেন। ১৮ জুলাই ১৯৪৩-এ ব্যাঙ্কক রেডিয়োর মাধ্যমে নেতাজি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন যে, আজাদ হিন্দ ফৌজে মুসলমানের সংখ্যা তখন বেশি ছিল, আর সাম্প্রদায়িক প্রীতি ছিল সত্যি গর্ব করার মতো। তিনি নিজে যথেষ্ট ভাল উর্দু বলতেন এবং শুদ্ধ সংস্কৃত প্রভাবিত হিন্দি শব্দের চেয়ে বেশি উর্দু-যুক্ত হিন্দুস্থানি শব্দ ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান নীতিবাক্য ছিল হিন্দুস্থানিতে: ‘ইত্তেফাক, ইতমদ, কুরবানি’— যার মর্ম হল ‘একতা, বিশ্বাস, আত্মত্যাগ’। ওই ফৌজের ৭৫তম বর্ষের অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী ঘটা করে সেই বিখ্যাত টুপি পরে খুব গর্বিত বোধ করলেন। তিনি এক জোরালো বক্তৃতাও দিলেন কিন্তু এই সব প্রসঙ্গ তো এক বারও উত্থাপন করলেন না। সুভাষ বসু কলকাতা পুরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালীন মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পদ সংরক্ষণ শুরু করলেন, আজকে যা অভাবনীয়।
অতএব নেতাজিকে হাইজ্যাক করার প্রাণপণ চেষ্টার আগে নরেন্দ্র মোদী যেন এই সব বিষয় মনে রাখেন। একই রকম লাগাতার প্রয়াস চালানো হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দকে গ্রাস করার। শুধু তাঁর গেরুয়া পোশাকটি দেখতে পেয়েছে। একটু পড়াশোনা করলেই বোঝা যেত যে, তিনি ধর্মান্ধ তো ছিলেনই না, তিনিই প্রথম বিশ্বসভায় খুবই গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষ ও হিন্দু সভ্যতা উভয়ই ঔদার্যের দৃঢ় প্রতিরূপ এবং সকলকে যুগ যুগ ধরে সম্মান দিয়ে এসেছে। দশ বছর আগের কথা বলি। ২০১০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের গৃহে যখন বিবেকানন্দের সার্ধশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জাতীয় কমিটির সভার পর, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি করে এগিয়ে সভাপতির হাতে একগুচ্ছ কাগজ দিলেন। আমায় তলব করাতে দেখলাম, ওই কাগজে তিনি তাঁর রাজ্যে স্বামীজিকে কেন্দ্র করে অনেক অনুষ্ঠানের দাবি করেছেন। বেশ কষ্টে তাঁর আধিকারিকদের মারফত বোঝাতে হল যে, স্বামীজি সারা মানবজাতির, কোনও একটি ধর্মের নয়। মজা হল, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের ব্যাপারে তখন তিনি একটুও আগ্রহ না দেখালেও এখন কথায় কথায় তাঁর বাণী শোনান। একমাত্র রামমোহনই দেখছি রেহাই পেয়েছেন। কারণ বোঝা কঠিন নয়!
আসলে বাংলার মহাপুরুষদের এমন টানাটানির প্রচেষ্টার তিনটি প্রধান কারণ আছে। প্রথম হল হিন্দুত্ববাদীরা এতই রক্ষণশীল ছিলেন ও আছেন যে, তাঁরা কোনও সংস্কার মুক্তের বা প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। অতএব অন্য কোথাও থেকে তাঁদের তো আনতেই হবে! আর এই বিষয়ে বাংলার চেয়ে বেশি নাম কোনও প্রদেশ দিতে পারে না। দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্ববাদীরা কখনওই স্বাধীনতা সংগ্রামের নিকটেও আসেননি, অতএব, আজ, নেহরু ছাড়া, যাকেই পাওয়া যায়, সেটুকুতেই তাঁদের লাভ। যদি সুভাষের মাপের কাউকে টেনেহিঁচড়ে তুলে আনা যায়, তবে তো জয়জয়কার। বিশেষত তিনি যখন কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।
তৃতীয়ত, নির্বাচন আসন্ন, এখনও এক-আধ জন মনীষীকে শিবিরে না টানা গেলে মুশকিল। অন্য দল ভাঙিয়ে নিজের দলে নিয়ে আসার মতোই ইতিহাস বিকৃত করে মহান পুরুষদের টানাটানি না করে তাই উপায় কী!