মায়ানমারের ঘনিয়ে ওঠা ভয়াল মেঘ ইতিমধ্যেই ছেয়ে ফেলেছে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলকে। এই মুহূর্তে আমরা এক অতিকায় মানবাধিকার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যদি অবিলম্বে এই সংকটের মোকাবিলায় শক্ত হাতে হাল না ধরা যায়, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে তা আমাদের ওপরে এসেই আছড়ে পড়বে। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর লাগাতার আক্রমণে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত। এই সময় এ ব্যাপারে ভারতের একটি পরিষ্কার ও দৃঢ় অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। কেউই ভারতকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য তার সীমান্ত খুলে দিতে বা শরণার্থী শিবির তৈরি করতে বলছে না। কিন্তু মানবতার প্রতি আমাদের যে দায়, তার মর্যাদা রক্ষা করা দরকার। কূটনীতির প্রয়োজনের চেয়ে সেই দায় অনেক বেশি মূল্যবান।
কিন্তু এই রোহিঙ্গারা আসলে কারা? তাদের নিয়ে এত সমস্যাই বা কেন? এই উপমহাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের নীচে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকা। এই এলাকাটি দক্ষিণে সমুদ্র উপকূল বরাবর একটি লম্বা হাতের মতো বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে এগিয়ে গিয়েছে। আরও দক্ষিণে এটি সরু একটি এলাকা দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে মায়ানমারে, যা বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। এই এলাকাটিরই নাম আরাকান বা রাখাইন প্রদেশ, আমরা যাকে মগের মুলুক বলে চিনতাম। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে রাখাইন রাজ্যই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকে শাসন করেছে। চট্টগ্রাম ছিল তাদের ঘাঁটি। দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল-এর মতো বাঙালি কবিরা এই সময়ে মনোরম রাখাইন প্রদেশেই তাঁদের কাব্য রচনা করেছেন। ১৬৬৬ সালে মুঘল সুবাদার এবং সেনানায়ক শায়েস্তা খান রাখাইন-মগদের পুরোপুরি ভাবে এই প্রদেশ থেকে উৎখাত করে চট্টগ্রাম ও তার সংলগ্ন বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেন। বাঙালিরা মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে আদৌ বিদেশ বলে মনে করত না। পরের শতাব্দীতে শাহ সুজা তাঁর ভাই সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে হেরে গিয়ে এই রাখাইনে আশ্রয় নেন। পরে কোনও অজ্ঞাত কারণে এই রাজ্যের প্রধানের হাতে নিহত হন তিনি।
এই অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং ভাষা বাংলা ভাষার থেকে কিছুটা আলাদাই রয়ে গিয়েছে। চট্টগ্রামের চলিত বাংলা ভাষা বাংলা ভাষার অন্যান্য চলিত রূপের চেয়ে একেবারেই আলাদা, আজও বেশির ভাগ বাঙালি সে ভাষা বুঝতে পারেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানতেই হবে যে, চট্টগ্রামের ভাষা বাংলা ভাষারই একটি রূপ। এখানকার হিন্দু ও মুসলমান বাসিন্দারা এই চাটগাঁইয়া-বাংলাতেই কথা বলেন, ঠিক যেমন চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের বড়ুয়া-বৌদ্ধরা এবং অন্য বাসিন্দারাও। বাংলা ভাষার এই আঞ্চলিক রূপটিই মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের লোকেদের প্রধান ভাষা। মুসলিম রোহিঙ্গা এবং বৌদ্ধ রাখাইন, উভয় গোষ্ঠীর মানুষই এই ভাষায় কথা বলেন। অবশ্য এর মধ্যে তাঁদের নিজস্ব প্রাদেশিক প্রচুর শব্দও ঢুকে গিয়েছে। এঁরা মায়ানমারের সরকারি ভাষাও ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু মায়ানমারের জনগণের কাছে এঁরা ‘বাংলা-বলা’ মানুষ। আর এটা মনে রাখতে হবে, মুসলমান রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের সঙ্গে মানসিক ভাবে খুবই একাত্ম বোধ করেন।
অনেকাংশে এই কারণেই মায়ানমারের মূলধারার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে এবং রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের, রোহিঙ্গা-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে তাতাচ্ছে। অথচ ইতিহাস বলছে, এক সময় এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের রাখাইন রাজ্যের অঙ্গ ভাবতে গর্ব বোধ করতেন, এবং এঁরা একযোগে মায়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিরুদ্ধে অনেক লড়াই করেছেন। এই অঞ্চলের কিছু বেপরোয়া নাবিক ও যোদ্ধা এক সময় পর্তুগিজ দস্যুদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং ভয়ংকর কিছু বাহিনী তৈরি করে। সেই মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা স্থলভূমির ভেতরে ঢুকে লুঠপাট করত, লোকজনকে ধরে নিয়ে যেত, শস্য ও সম্পত্তি তছনছ করে দিত। তাদের এই উপদ্রব প্রায় দুশো বছর চলেছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ অবধি। অবশেষে ১৭৮৫ সালে রাখাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে মায়ানমার এই প্রদেশকে নিজের দখলে আনে। কিন্তু তার চল্লিশ বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার রাখাইন প্রদেশকে ব্রিটিশ-ভারতের অঙ্গ করে নেয়। তারা প্রধানত চট্টগ্রাম এবং অংশত নোয়াখালি থেকে প্রচুর মানুষকে রাখাইন প্রদেশে বসতি করায়। এবং এর কয়েক বছরের মধ্যে ব্রিটিশরা মায়ানমারকেও দখলে আনার পর এখনকার বাংলাদেশ থেকে আরও বহু মানুষ গিয়ে রাখাইন প্রদেশে থাকতে আরম্ভ করেন। ভারত হয়তো এখন বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলমান রোহিঙ্গাদের ভুলে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু উভয় গোষ্ঠীই ভারত এবং বাংলাদেশ নিজেদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করে, যদিও ভিন্ন ভিন্ন কারণে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা মায়ানমার দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা তখন কিছু দিনের জন্য মায়ানমার ছেড়ে গেলেও ফের জাপানিদের প্রত্যাঘাত এবং মায়ানমারের দখল নেওয়ার জন্য মায়ানমারি এবং রাখাইন-রোহিঙ্গা, উভয় গোষ্ঠীর মানুষদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেয়। ১৯৪৭ সালে মায়ানমার স্বাধীনতা পাওয়ার পর সে দেশের মানুষের মধ্যে এক নতুন জাতীয়তাবাদী মনোভাব তৈরি হয়। সেই জাতীয়তাবাদের নিশানা হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক ভাবে সফল সেখানকার ভারতীয়রা, এবং রোহিঙ্গা মুসলমানরাও, বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা খুব উদ্যোগী ছিল।
১৯৬২ সালে মায়ানমারের সামরিক শাসক জেনারেল নে উইন দেশের এই জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়ে দেশের প্রায় সমস্ত শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন। ফলে ভারতীয়রা বাধ্য হন মায়ানমার ছাড়তে। সামরিক সরকার তখন ব্যবসায় সফল বাঙালি মুসলমান-রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ-রাখাইনদের খেপিয়ে তোলে। তারা মুসলমান-রোহিঙ্গাদের ওপর তুমুল অত্যাচার শুরু করে। ক্রমাগত লুটপাট, ভাঙচুর, হত্যার এই হিংস্র ধারা চলতেই থাকে।