গত ৩০ ডিসেম্বর এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছিলাম আমরা: এক কারাগারের একটি কক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে রয়েছেন। কিন্তু তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলেন না। তিনি শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন তাঁর গুরু, ‘বীর’ বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে, যিনি ওই কারাকক্ষে বন্দি ছিলেন বেশ কিছু কাল। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কয়েক ফুট দূরত্বে রাখা সাভারকরের ছবির ওপর। ‘হিন্দুত্ব’-এর ধারণাটির স্রষ্টা সাভারকর এই মতবাদের জনক হিসাবে স্বীকৃত। তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এক হিন্দু ভারতের স্বপ্ন দেখতে এবং তার জন্য দাবি জানাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। যে কারাগার পরিদর্শনে মোদী গিয়েছিলেন, সেটি হল আন্দামানের সেলুলার জেল। ভয়ঙ্কর ‘কালা পানি’র কথা ভারত কখনও ভুলতে পারবে না। এই সেই কুখ্যাত জেলখানা যেখানে শয়ে শয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দি ছিলেন। তখনকার ভারতের সেই সেরা তরুণরা কখনও ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাননি। কিন্তু এক জন ছিলেন ব্যতিক্রম— তিনি তৎকালীন বড়লাটের কাছে বার বার আকুল প্রার্থনা জানিয়েছিলেন তাঁকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তিনি হলেন বীর সাভারকর, মোদীর হিরো। ১৯৭৫ সালে ভারত সরকারের প্রকাশিত পিনাল সেট্লমেন্ট ইন আন্দামানস নামক রিপোর্টের ২১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় নথিভুক্ত রয়েছে ভি ডি সাভারকরের ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখের সেই দয়াভিক্ষার আবেদন। সাভারকরের মিনতি ছিল, ‘‘যদি ব্রিটিশ সরকার তাদের বদান্যতা এবং দয়ায় আমাকে মুক্তি দেয়, তা হলে আমি সাংবিধানিক প্রগতির, এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যের প্রবলতম প্রচারক হব।’’ ‘১৯১১ সালে ক্ষমাভিক্ষা করে যে আবেদন পাঠিয়েছিলাম’, এই আবেদনে সাভারকর তার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। আরও প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলে ‘‘ভারত ও ভারতের বাইরের সেই সমস্ত তরুণকে সমবেত করবেন যারা আমার পথনির্দেশের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।’’ ব্রিটিশ রাজের কাছে সাভারকরের এই শোচনীয় বশ্যতা স্বীকারের কথা উহ্য রেখে মোদী টুইট করেছিলেন, ‘‘আমি কারাগারের সেই কক্ষ পরিদর্শন করলাম যেখানে অপ্রতিরোধ্য সাভারকরকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ভয়াবহ বন্দিদশা তাঁর অদম্য মানসিক দৃঢ়তাকে নত করতে পারেনি এবং তিনি জেলে বসেও এক মুক্ত ভারতের আশায় কথা বলেছেন এবং লিখেছেন।’’
প্রসঙ্গত, বিজেপি সরকার আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার বিমানবন্দরের নামকরণ করেছে সাভারকরের নামে, এবং সেলুলার জেলে
‘সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো’-এর অনেকটাই সাভারকরকে নিয়ে। যে অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামী অসম্ভব অত্যাচার এবং আঘাত সয়েও ভেঙে পড়েননি, তাঁদের অনেকে তো এই জেলেই মারা গিয়েছেন, তাঁদের কথা এই শো-এ তুলনায় অনেক কম বলা হয়েছে।
মনে রাখা দরকার, ভারতের বর্তমান শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির জনক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ভারতের জাতীয় পতাকার এবং তার ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করেছিল। এমনকি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, তাতেও তারা যোগ দেয়নি। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার কে বি হেডগেওয়ার আদেশ জারি করেছিলেন, তাঁদের কর্মীরা যেন গাঁধীকে সমর্থন না করে। হেডগেওয়ার-এর জীবনীকার সি পি বিশিকার তাঁর বইয়ে হেডগেওয়ারের কথা উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘‘জেলে গেলেই দেশপ্রেম হয় না। অগভীর স্বদেশপ্রেমের আবেগে ভেসে যাওয়া কোনও কাজের কথা নয়।’’ এমনকি, ন্যাশনাল আর্কাইভস-এর তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ পুলিশের কিছু অংশ আরএসএসকে তাদের অনুগত বন্ধু মনে করত। এ এক নিষ্ঠুর পরিহাস যে, আজ সেই আরএসএস এবং তার অনুগামী রাজনৈতিক দল বিজেপি দাবি করে, তারা প্রবলতম জাতীয়তাবাদী, বস্তুত অতিজাতীয়তাবাদী। এবং সাধারণ মানুষ সর্বসমক্ষে কতটা জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন করলে তবে প্রমাণিত হবে যে সে এক জন খাঁটি ভারতীয়, সেটা তারাই ঠিক করে দেয়!
১৯৪৭-এর অগস্টে স্বাধীনতার ঠিক আগে আরএসএস-এর মুখপত্র, ‘অরগানাইজ়ার’ ঘোষণা করেছিল যে, ভারতীয় ‘তেরঙা’ ‘‘কখনওই হিন্দুদের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে পারবে না। তিন সংখ্যাটি এমনিতেই অশুভ, পতাকায় তিনটি রং থাকায় মানুষের মনে এক অশুভ প্রভাব পড়বে এবং তা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।’’ (যদি তিন সংখ্যাটি অশুভ হয়, তা হলে হিন্দু ত্রিমূর্তিও কি অশুভ?) এর আগে, ১৯৪৭-এর ১৭ ও ২২ জুলাই ‘অরগানাইজ়ার’-এর দু’টি সংখ্যাতেও জাতীয় পতাকার প্রতি আরএসএস-এর বিরাগের কথা লেখা হয়েছিল। সঙ্ঘের দ্বিতীয় কর্ণধার ও অবিসংবাদিত নায়ক এম এস গোলওয়ালকরও অত্যন্ত জোর দিয়ে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন তাঁর বই বাঞ্চ অব থটস-এ। তিনি সাফ সাফ বলেছিলেন, ‘‘আমাদের নেতারা একটি নতুন পতাকা তৈরি করেছেন দেশের জন্য। কিন্তু কেন? আসলে এটা অনুকরণ এবং বিচ্যুতির প্রকাশ... আমাদের দেশ প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী একটি দেশ, তার একটা সুবর্ণময় অতীত রয়েছে। আমাদের নিজস্ব কোনও পতাকা কখনও ছিল না? হাজার বছর ধরে আমাদের কোনও জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিশ্চিত ভাবেই ছিল। তা হলে আমাদের মনে কেন এমন শূন্যতা, এই অন্তঃসারহীনতা?’’ (নিজস্ব পতাকা বলতে) গুরু গোলওয়ালকার বোধ হয় আরএসএস-এর গৈরিক ‘চেরা পতাকা’র কথা বলছিলেন, যা ভাগওয়া ধ্বজ নামে পরিচিত। তিনি বোধ হয় ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত তেরঙার বদলে আরএসএস-এর পতাকাটিকেই দেশের জাতীয় পতাকা করতে চেয়েছিলেন।
হিন্দু মহাসভার মতাদর্শে দীক্ষিত এক ধর্মান্ধ ব্যক্তি গাঁধীকে খুন করার পর (যে খুনকে, প্রসঙ্গত, আরএসএস উদ্যাপন করেছিল) সর্দার বল্লভভাই পটেল যদি আরএসএসকে আঠারো মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা না করতেন, তা হলে তারা হয়তো কোনও দিনই নিজেদের অবস্থান বদলাত না। যখন সর্দার পটেল শয়ে শয়ে সঙ্ঘের কর্মীদের গ্রেফতার করেন, তখনই, ১৯৪৯ সালে, গোলওয়ালকর বাধ্য হয়ে ‘ভারতীয় সংবিধান ও জাতীয় পতাকার প্রতি আনুগত্য’ স্বীকার করেন।
মোদী জনসাধারণের ৩০০০ কোটি টাকা খরচ করে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মূর্তি হিসেবে সর্দার পটেলের মূর্তি গড়েছেন। প্রশ্ন জাগে, তাঁর কি এ কথা স্বীকার করার সততা আছে যে, সর্দার পটেল সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে কী পদক্ষেপ করেছিলেন? এটা দেখে সত্যিই দুঃখ হয়, যে পতাকাকে সঙ্ঘ একদা অস্বীকার করেছিল, সেই জাতীয় পতাকার প্রতি কী ভাবে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে সেটা আজ আরএসএস-বিজেপির লোকজনই ঠিক করে দিচ্ছে, কেউ (তাদের বিচারে) সেই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হলে ওরাই শাস্তি দিচ্ছে বা শাস্তির ভয় দেখাচ্ছে! স্বাধীনতা আন্দোলনে বিজেপি-আরএসএস-এর কোনও বড় ভূমিকা ছিল না, তাদের কোনও জাতীয় নেতাও ছিলেন না, তাই এখন সর্দার পটেল, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ মূলস্রোতের নেতাদের নিজেদের বলে দাবি করার চেষ্টা করছে তারা।
সত্তর বছরের ওপর, ভারতীয় রাজনীতিতে আরএসএস প্রথমে জনসঙ্ঘ, পরে জনতা পার্টি এবং তার পর থেকে বিজেপির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। গণতন্ত্রে যেমন বামপন্থার প্রয়োজন আছে, তেমনই প্রয়োজন আছে দক্ষিণপন্থারও। কিন্তু যে কোনও ধারার রাজনীতিকেই বহুমাত্রিক পরিসরকে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নিয়েই চলতে হবে, ঠিক যেমনটা আমাদের সংবিধানে বলা রয়েছে। সেটা তো মানাই হচ্ছে না, বরং সংখ্যালঘু, দলিতদের ওপর সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে, সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারপন্থীরাও। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একমাত্র ১৯৭৫-৭৭ সালে অর্থাৎ জরুরি অবস্থার পর্বে আরএসএস-এর রাজনৈতিক শাখা দেশের পক্ষে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। স্বৈরাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে সঙ্ঘের সমর্থকরা দলে দলে জেলে গিয়েছিলেন। অবশ্য মনে রাখতে হবে, সংগঠনের সমর্থক ব্যবসায়ীরা সে দিন ওই জেলে যাওয়া আন্দোলনকারীদের অনেকের পরিবারকেই সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন।
যাঁরা গাঁধীজির জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, আজও যাঁদের সতীর্থরা ৩০ জানুয়ারি আলিগড়ে গাঁধী-হত্যার ‘পুনরভিনয়’ করে নাথুরাম গডসের নামে জয়ধ্বনি দেন, তাঁরাই জাঁকজমক করে তাঁর ১৫০তম জন্মশতবার্ষিকী পালন করছেন! সাভারকর এবং গোলওয়ালকরের গুণমুগ্ধ, আরএসএসের তাঁবে থাকা সরকার যখন ঔপনিবেশিক জমানা থেকে চলে আসা আইন কাজে লাগিয়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কানহাইয়া কুমার ও তাঁর সহযোগীদের দেশদ্রোহের অভিযোগে চার্জশিট ধরায়, তখন ইতিহাস হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না।