বাস্তবে পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ের পর ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেই অনাদায়ী ঋণকে অকার্যকর সম্পদ হিসেবে দেগে দেওয়া হয় না। ব্যাঙ্ক বছরের পর বছর ধরে সেই খাতটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, সেই লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ করে, তারপর সেটাকে ‘ক্ষতি’ বলে চিহ্নিত করে।

ভারতের অকার্যকর সম্পদের অনুপাত

প্রতিটি অনাদায়ী ঋণ অকার্যকর সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হয় না। এনপিএ কথাটি প্রযোজ্য সেইসব ব্যাঙ্ক ঋণের ক্ষেত্রে যেগুলি পরিশোধের সময় ৯০ দিনেরও বেশি পেরিয়ে গিয়েছে। এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবে পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ের পর ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেই অনাদায়ী ঋণকে অকার্যকর সম্পদ হিসেবে দেগে দেওয়া হয় না। ব্যাঙ্ক বছরের পর বছর ধরে সেই খাতটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, সেই লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ করে, তারপর সেটাকে ‘ক্ষতি’ বলে চিহ্নিত করে। ওই অ্যাকাউন্ট ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলার আগে ব্যাঙ্ক চার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ঋণ কাঠামোর অদলবদল করে মূল টাকাটা এবং তার সঙ্গে যতটা পারা যায় সুদের পরিমাণ উদ্ধারের প্রয়াস চালায়।

সকল ঋণখেলাপিই অপরাধী নন। বহু ক্ষেত্রে বাজারের গতিপ্রকৃতির কারণেই গ্রাহক সত্যি-সত্যিই ক্ষতির মুখে পড়ে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারান। আসলে ভারত এবং বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের আরও কয়েকটি দেশে ব্যাঙ্ককে প্রতারণার বিষয়টা বেশ ভালমতো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাজনৈতিক মদতের সুবাদে, ভুয়ো ব্যবসা-প্রস্তাব প্রদানের সৌজন্যে, প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কাগজে-কলমে কম বা বেশি ব্যয়, যাকে পরিভাষায় আন্ডার-ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং বলা হয়, তার মাধ্যমে, ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ও সম্পদ ভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে। এসব সুপরিকল্পিত পদ্ধতি প্রয়োগ করেই একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘রুগ্ণ’ করে ফেলা হয়।

সমগ্র পৃথিবীতে প্রচলিত প্রথা হল এটাই যে, ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর মোট ঋণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের ১ থেকে ২ শতাংশ অকার্যকর সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হয়। এমনটা ধরাই থাকে, তা সত্ত্বেও সম্পত্তিকে তরল অর্থে রূপান্তরিত করেই হোক বা আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমেই হোক, যেভাবেই হোক ব্যাঙ্কগুলো অনাদায়ী ঋণ আদায়ের চেষ্টা চালিয়েই যায়।

আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা আইএমএফ এই প্রক্রিয়া-পদ্ধতি সমর্থন করে। এই সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপিয়ান কমিউনিটির অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ দেশে মোট এনপিএ-র অনুপাত ১.১ শতাংশের আশেপাশে থাকে, খুব বেশি হলে ১.২ শতাংশে পৌঁছায়।

এই দেশগুলোতে আর্থিক সংস্থার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কড়া, জনসচেতনাও খুব বেশি আর রাজনৈতিক মদতদান অত্যন্ত কম। কানাডার এনপিএ মাত্র ০.৪ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই অনুপাত কেবল ০.৫ শতাংশ। সুইৎজারল্যান্ডে এটা ০.৬ শতাংশ। যারা ব্যাঙ্ক প্রতারণার সঙ্গে জড়িত, চিনে তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হয়। ফলে, সেদেশে এনপিএ অনুপাত ১.৮ শতাংশ। প্রগতিশীল এশীয় দেশগুলিতে এনপিএ-র অনুপাত হয় এর চেয়েও কম নয়, এর কাছাকাছি। এর বেশি নয়। কিন্তু যদি রাশিয়ার দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখব, সেদেশে রাজনীতির সঙ্গে পুঁজির একটা অশুভ আঁতাত রয়েছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতিকদের জোট সেদেশে অতি-পরিচিত ঘটনা। ফলে সেই দেশে এনপিএ বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৩ শতাংশ। কিন্তু ভারত, আমার ভারতবর্ষ, ব্যাঙ্ক প্রতারণার ক্ষেত্রে এদের সব্বাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিশেষত মোদিজি-শাসিত ভারতেই এটা বেশিমাত্রায় ঘটেছে। সরকারি তথ্য এই বক্তব্যকে সমর্থন করছে।

কেন্দ্রীয় অর্থ-মন্ত্রক প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, মোদি যখন ক্ষমতায় আসেননি এবং দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার যখন বিদায়ের পথে, তখন ৩১ মার্চ, ২০১৪-তে এই এনপিএ অনুপাত ছিল ৪.১ শতাংশ আর মোদি-জমানায় ৩১ মার্চ, ২০১৮-তে তা শিখরে পৌঁছায়, হয় ১১.৪৬ শতাংশ। তবে অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী বহু সাধাসাধির পর তাঁর আমাকে দেওয়া শেষ পত্রে জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২-এ এনপিএ কমে ৪.৪১ শতাংশ হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লখযোগ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কিন্তু তার আর্থিক স্থিতিশীলতা-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্যটি জোর দিয়ে জানাতে পারেনি। তাদের অনুমান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর এনপিএ ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে ফুলে-ফেঁপে ৯.৪ শতাংশে পরিণত হবে আর বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর ক্ষেত্রে অঙ্কটি দাঁড়াবে ৫.৮ শতাংশে। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সম্প্রতি এনপিএ-পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়শীল দেশসমূহ যেখানে এনপিএ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সমধিক এবং শাসক গোষ্ঠীর অতি-ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব একটু হলেও কম, সেইসব দেশের তুলনায় ভারতের এনপিএ অনুপাত দু-তিন গুণ বেশি।

এনপিএ অনুপাত এবং খেলাপি ঋণ মুছে ফেলার ব্যাপারে ভারত বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে। বিষয়গুলোকে অনিবার্য বলে উড়িয়ে দিয়েছে মোদি সরকার। আর্থিক নীতির বাড়াবাড়ির কারণেই এমনটা ঘটেছে বলে লঘু করে দেখানোর চেষ্টাও চলেছে। কিন্তু সত্যিটা হল এই যে, অর্থ বা টাকাটা কখনওই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি, খোয়া যায়নি। যারা এ-বিষয়ে উদাসীন তাদের বেবাক বুদ্ধু বানিয়ে যারা আতি-চালাক, তাদের ভাঁড়ারে জমা হয়েছে। যে-যেভাবে পারে ওই টাকা হাতিয়েছে।

২০১৪ থেকে মোট এনপিএ-র পরিমাণ ৬৭.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা

যা সবচেয়ে চিন্তার আশঙ্কার ও অস্বস্তিকর, সেটা হল প্রদত্ত মোট ঋণের সাপেক্ষে কত শতাংশ অকার্যকর সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হয়েছে তা নয়, সেটা হল নরেন্দ্র মোদির ন’বছরের শাসনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাঙ্কগুলো খুইয়েছে, তার অঙ্কটা। মোদির শাসনকাল অবশ্য ন’বছরের নয়, আট বছর ন’মাসের। এই সময়কালের তথ্যাদি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক আমাদের দিয়েছে।

মোট এনপিএ-র পরিমাণ জানলে চক্ষুচড়কগাছ হওয়ার জোগাড় হবে। অঙ্কটা ৬৭.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অংশ ৫৪.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা। বাকিটা বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাঙ্কের অংশ। তবে এগুলোর সবটাই উদ্ধার করার প্রক্রিয়ার অধীন। যে অঙ্কটা ব্যাঙ্কের হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে, সেটা বেশ আশঙ্কাজনক। তবে, সত্যি কথা বলতে কী, এই অঙ্কটাও চূড়ান্ত নয়, কারণ এর থেকেও কিছু টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে ফেরত আসে। কিন্তু যে অঙ্কের টাকা মোদি জমানায় নয় বছরে একেবারে হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেছে যা আর ফিরে আসবে না, চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া সেই অর্থের পরিমাণ হল ৬৭.৬৬ লক্ষ কোটির মধ্যে ১২.১৬ লক্ষ কোটি। এটা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

যে অঙ্কের টাকা মোদি জমানায় নয় বছরে একেবারে হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেছে যা আর ফিরে আসবে না, চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া সেই অর্থের পরিমাণ হল ৬৭.৬৬ লক্ষ কোটির মধ্যে ১২.১৬ লক্ষ কোটি। এটা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরাই দেশ চালাচ্ছে

সন্দেহ নেই বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগী সত্যি সত্যিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ক্ষতি হয়েছে তাঁদের, ঋণ শোধের ক্ষমতা হারিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু চিরকালের জন্য গায়েব হয়ে যাওয়া এই বিরাট অঙ্কের মধ্যে একটা বিশাল অংশ ঢুকেছে একদল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি আর তাদের রাজনৈতিক মদতদাতাদের পকেটে। ভারতে ব্যাঙ্কের ঋণ খেলাপিদের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থায় বেশ কিছু বদল আনা হয়েছে। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, চিন ও বিশ্বের অপরাপর উন্নত দেশসমূহে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে মোট ক্ষতির পরিমাণ ভারতের এই খাতে বিরাট ক্ষতির একটা ভগ্নাংশমাত্র।

এক্ষেত্রে যে কথাটা সবচেয়ে আতঙ্কের, সেটা হল এই যে, আপনার আমার জমানো টাকা আর ব্যাঙ্কের অর্জিত অর্থের একাংশ আসলে ওই উধাও হয়ে যাওয়া ১২.১০ লক্ষ কোটি টাকা। সরকার মাঝে-মধ্যেই ব্যাঙ্কের মূলধনে জোগান দেয় কিন্তু সেই টাকাটা আসে আমাদের দেওয়া কর থেকে এবং সেটার পরিমাণও অত্যন্ত কম। সুতরাং, আমাদের জমানো টাকাই হোক আর আমাদের দেওয়া করের টাকাই হোক, ব্যাঙ্কের ক্ষতি মানে শেষমেশ জনগণের ক্ষতি।

আর্থিক তছরুপের অঙ্কটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু কী আশ্চর্য, ইডি-র ওইসব অতিধনী তছরুপকারীদের নিয়ে ভাবার সময় নেই। তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে যে সকল বিরোধী রাজনীতিক রাজ্যস্তরে নগদ অর্থে লেনদেনের অভ্যাস বজায় রেখেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদের গ্রেফতার করতে। এই সকল রাজ্যস্তরের রাজনীতিকের টাকার খিদে এবং অর্থ গেলার ক্ষমতা ছোট, বড়জোর মাঝারি। কিন্তু নগদবিহীন লেনদেনে যে বিরাট অঙ্ক গিলে ফেলা হয় সেই পরিমাণের তুলনায় এটা কিছুই না। এঁরা সব পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলের রাজনীতির কুশলী কর্মী। তাঁরা বিমানচালকের কক্ষ ককপিটে বসে সবকিছু চালান, নিয়মনীতি আইনকানুনের মেঘমালার ভেতর দিয়ে উড়ান বজায় রাখেন, যা কিছু সামনে পড়ে সে-সবকে প্রয়োজনমাফিক বদলে দেন। বৃহৎপুঁজির সঙ্গে রাজনীতির কারবারিদের এত দহরমমহরম অতীতে কোনও জমানায় দেখা যায়নি। ‘সব কুছ ঠিক হ্যায়’ বলে চালিয়ে দেওয়ার এমন প্রবণতাও ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।

কোনও কিছুই বিনা পয়সায় মেলে না। কোনও আনুকূল্যই প্রতিদানবিহীন নয়। ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক-প্রতারণার বিষয়টাও আমরা হইচই না-করা পর্যন্ত দিব্যি চেপে যাওয়া হয়েছিল।

অর্থনীতি এমনিতে একটি নীরস শুষ্ক বিষয়। এতে প্রাণের রস কৌতূহলের পারদ অ্যাড্রেনালিন হরমোনের উত্তজনা আনার জন্য হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের দরকার পড়ে। ওরকম প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তখনই অর্থনীতির ওপর নজর পড়ে।

জনগণ জেগে না উঠলে কিচ্ছুটি ধরা পড়বে না। সবকিছু অজানা আর অধরাই রয়ে যাবে। আমরা টেরই পাব না ‘পরিকল্পিত’ ক্ষতির মুখে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে ফেলে সেটার ঘাড়ে যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দেওয়া হবে আর আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে যেটুকু সঞ্চয় করার সামর্থ্য আমাদের হয়েছে, সেই টাকাটা ব্যক্তিগত মুনাফা হয়ে প্রতারকদের পকেট মোটা করবে। ব্যাঙ্কের আমানতের অর্থ লুঠ করে শাসক-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা ঘুরে বেড়াবে আর তাদের কেউ ধরার চেষ্টাও করবে না।

No comments on 'লুঠ হয়ে গেছে ব্যাঙ্কের টাকা'

Leave your comment

In reply to Some User