নরেন্দ্র মোদি যে এখন কতখানি মরিয়া হয়ে উঠছেন সেটা তাঁর দৈনন্দিন বিভিন্ন হতাশা প্ররোচক পদক্ষেপ থেকেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। একদিন হঠাৎ দিল্লির ঐতিহাসিক ইন্ডিয়া গেটের অমর জওয়ান জ্যোতি চিরকালের মতো বুজিয়ে দেন আবার তার পরের দিন সকলের হইচই দেখে তাড়াহুড়ো করে একটি ঘোষণা করলেন যে ওর পাশের বেদিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একটি মূর্তি স্থাপিত হবে।
এইসব নাটকীয় ঘটনার বাইরে যদি আমরা নরেন্দ্র মোদির আচরণ দেখি, তবে একটি জিনিস স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, তা হল, ভারতীয় সংবিধানের কয়েকটি মূলগত নীতি তিনি শুরু থেকেই মানতে চাননি। ইন্দিরা গান্ধির বদনাম ছিল তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, নিজের শাসনকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে সেই সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকটি সাংবিধানিক সংশোধনও এনেছিলেন নরেন্দ্র মোদি ওই পথেই পা মাড়াননি। অথচ তিনি ইন্দিরা গান্ধির চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ জরুরি অবস্থা লাগু করেছেন তাঁর জমানার প্রথম বছর থেকেই, আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করেই।
এ ব্যাপারে প্রথম উদাহরণ হল নাগরিকত্ব আইন। নাগরিকত্ব আইন মোদি সরকার যেভাবে বলবৎ করার চেষ্টা করেছে, তা ঘোরতর সংবিধান বিরোধী, কারণ সংবিধান প্রতিটি মানুষের জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমান অধিকার স্বীকার করে। নাগরিকত্ব আইন সেই সাংবিধানিক অধিকারে বৈষম্য আনার চেষ্টা করেছে, ভারতীয়ের সঙ্গে ভারতীয়ের বিভেদ রচনা করছে।
ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ছিল তিনি সুপ্রিম কোর্টে তাঁর নিজের লোক বসিয়েছেন। পঞ্চাশ বছর পরেও এ সংক্রান্ত আলোচনায় ঘুরে ফিরে তিন চার জনের নাম আজও শোনা যায়। এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি যে ইন্দিরা গান্ধিকে কী মাত্রায় ছাড়িয়ে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি প্রথমে শুরু করেছিলেন সংঘাত দিয়ে, তার পর সমঝোতায় চলে এসেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে গত কয়েক বছরে যে চারজন আসীন হয়েছিলেন, সেই চারজনই তাঁর সমর্থক। মাফ করবেন, ‘সমর্থক’ ব্যতীত আর কোনও শব্দ তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাচ্ছে না এবং এর সপক্ষে তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে যা সময় আসলেই জনসমক্ষে আনা হবে। এই চারজন প্রধান বিচারপতিই মোদিজীর মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তাঁর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ। শুধু প্রধান বিচারপতিবর্গ নন, অরুণ মিশ্রের মতো বিচারপতিও বসেছেন শীর্ষ আদালতের আসনে যিনি মোদির পক্ষে যে ব্যবসায়ীরা আছেন তাঁদের মুনাফার অঙ্ক কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর জন্য তাঁদের পক্ষে ক্রমাগত রায় দিতে ইতস্তত করেননি। এই অরুণ মিশ্র প্রকাশ্যে বলেছিলেন, মোদিজী প্রায় ভগবানের সমান আর সেই অরুণ মিশ্রকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করে দেওয়া হল, যে মানবাধিকার কমিশনের প্রথম কাজ হল পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে মানাবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত করা। সারা ভারতে যে মুসলিম নিধন চলছে, যেভাবে খাদ্যাখাদ্য বিচার নিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে, সেদিকে মানবাধিকার কমিশনের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। এরকমভাবে বশীভূত সুপ্রিম কোর্টের কাছে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি নিয়ে, কাশ্মীরে দিনের পর দিন জরুরি অবস্থার ভ্রুকুটির বিষয়ে, কিংবা আর্মড ফোরসেস স্পেস্যাল পাওয়ার অ্যাক্ট নিয়ে, নাগরিকত্ব আইনের বৈধতা নিয়ে সুবিচার পাওয়া যায়নি, পাওয়াটা সম্ভবও ছিল না। ইভিএম নিয়ে ভিপ্যাট নিয়ে মামলা দায়ের করলাম, কিন্তু শুনানি এতদিনেও হল না। হল না কারণ, মোদিজীর মর্জিমতো চললে রাজ্যসভার সদস্য হওয়া যায়, নইলে সেসব জোটে না।
তবে আমদের সৌভাগ্য বর্তমানে যিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তিনি নরেন্দ্র মোদির ভাবাদর্শে বিশ্বাসী কেউ নন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তও নন। পাঁচ ছয় বছর পর এই প্রথম একজন মুখ্য বিচারপতি নরেন্দ্র মোদির একচেটিয়া চলার পথে কিছুটা হলেও রুখে দাঁড়িয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থার মাথাতেও মোদিজী নিজের পেটোয়া লোক বসিয়েছেন। পূর্বতন মুখ্য নির্বাচনী কমিশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিবদ্ধ করলে তা তো টেলিফোন ডাইরেক্টরির মতো বিপুলায়তন হয়ে যাবে। তিনি মোদিজীর অনুকূলে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, আর এখন অপেক্ষমাণ অন্য কোনও পদ প্রাপ্তির আশায়।
সিএজিতেও বসান হয়েছে এমন একজনকে যিনি ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গার সময় ছিলেন মোদিজীর সচিব। তিনিই আক্রান্ত মুসলমানদের যাবতীয় অভিযোগ সামলাতেন এবং মোদিজীর গায়ে যাতে কোনও আঁচ না পড়ে সেটা তিনি সাত বছর দেখে গিয়েছেন। এঁকে মোদি পরে নিজের ব্যক্তিগত সচিব করেছিলেন আর অল্প বয়সেই কাশ্মীরে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের মতো দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এখন তাঁকে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল করে আনা হল যাতে তাঁর পরের কাজ হবে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোর হিসাবপত্রে খুঁত খুঁজে তাদের গায়ে কেলেংকারির কাদা ছেটান যায় আর মোদি শাসিত কেন্দ্রের করা কোনও পাপই যাতে বাইরে না আসে তা নিশ্চিত করা যায়।
এই মোদিজী প্রথম দিন সংসদে প্রবেশ কালে মাটিতে মাথা ছোঁয়ানোর নাটক করেছিলেন। তার পর থেকে শুরু করে দিলেন সংসদীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংসের আয়োজন। গত অধিবেশনে ১২ জন বিরোধী সাংসদকে বহিস্কার করা হল। এরকম বেনজির ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্য একটাই, আত্মমর্যাদা থাকলে বিরোধী পক্ষ সংসদের অধিবেশন বয়কট করবে আর সেই সুযোগে সরকার পক্ষ বিতর্কিত বিলগুলো পাস করিয়ে নেবে। সংসদকে কীভাবে ধ্বংস করছেন মোদি, তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমাণ কৃষক বিল। রাতের অন্ধকারে বিল পেশ করা হল, ৩৬ মিনিট আলোচনার পর সেই বিল আইনে পরিণত হল। শেষে এক বছর লাগাতার আন্দোলনের জেরে সেই বিলটিকেই মোদি সরকার একটু টোম্যাটো সস ছিটিয়ে গিলে নিতে বাধ্য হলেন। এর পরেও যে তাঁর কোনও শিক্ষা হয়েছে তা কিন্তু নয়। এখনও সেই খেলা অব্যাহত। এভাবেই কোনও আইন পাস হয় ১৩ মিনিটে, কোনোটি ১৭ মিনিটে, এভাবেই তিনি সংসদকে ‘সম্মান’ দিচ্ছেন। আর তাঁর এক অনুগামী নতুন সংসদ ভবন বানাচ্ছেন যেখানে সেন্ট্রাল হলের মতো কোনও কমন স্পেস নেই যেখানে দল মত নির্বিশেষে সাংসদরা নিজেদের মধ্যে মতের আদানপ্রদান করতে পারেন আর সেটাই তো সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা।
এরকম ব্যক্তির হাতে ভারতের সংবিধান ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র আদৌ নিরাপদ নয়।