পরিযায়ী শ্রমিকরা হয়তো এটা তাঁদের পরম সৌভাগ্য বলে মনে করবেন যে, লকডাউনের ৭৫ দিন পরে দেশের বিচারালয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদের দুঃখ স্বীকৃতি পেল। এর আগে যত বার উচ্চতম ন্যায়ালয়ের সামনে তাঁদের মর্মান্তিক অবস্থার কথা বলা হয়েছে, তত বারই অনেক বকুনি শুনতে হয়েছে। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আকস্মিক ফতোয়ার পর থেকেই যখন পরিস্থিতি বেসামাল হতে আরম্ভ করল, তখনই বেশ কিছু জনমুখী প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় সুপরিচিত ব্যক্তি ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। কিন্তু তখনও সরকার পক্ষের কথাই মান্য হয়।
৩১ মার্চ সলিসিটর জেনারেল নির্দ্বিধায় জোর গলায় সুপ্রিম কোর্টে ঘোষণা করেন, “এই দেশে এমন কোনও মানুষ নেই, যাঁরা নিজের গ্রাম বা শহরে পৌঁছনোর জন্যে পথে হেঁটে চলেছেন।” আদালত হলফনামা মেনে নেয়, সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা মামলা করেছিলেন, তাঁদের প্রতি যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে। এমনকি, গণমাধ্যমে সেই ভয়াবহ ও করুণ চিত্র, যা দেখে সারা দেশের লোক মর্মাহত, তা-ও মান্য হয়নি। শ্রমিক পক্ষের উকিলদের পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, “ওঁদের যখন সরকার খাবার দিচ্ছে তবে আবার টাকা কেন দেবে?” কোনও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বিচারবিভাগের এত বিশ্বাস কি গত চার-পাঁচ দশকে দেখেছে এই দেশ?
ভারতীয় সংবিধানে এই শ্রমিকদের ব্যাপারে ক্ষমতা এবং দায়বদ্ধতা আসলে কার?
সংবিধানের ২৪৬ নম্বর ধারার সঙ্গে সপ্তম অনুসূচির প্রথম তালিকার ৮১ নম্বর অনুচ্ছেদ পড়লেই দেখা যায়, ‘ইন্টারস্টেট মাইগ্রেশন’ বা আন্তঃরাজ্য অভিবাসন এবং কোয়রান্টিন, এই দু’টি বিষয়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণত কেন্দ্রীয় সরকারের। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৯ সালে মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভা একটি আইনও বলবৎ করেছিল, যার নাম আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমজীবী আইন। এই আইন কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় শ্রম কমিশনারের সংস্থাকে কিছু লোকজনও দেওয়া হয়েছে, যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না-ও হতে পারে, কেননা ওই দফতরের আধিকারিকদের আরও ১৩টি শ্রম বিষয়ক আইন সামলাতে হয়। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত আইনের কথা ভুলে বা নিজেদের সংবিধানিক দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে নীরব দর্শক থেকে সাধারণ মানুষকে শুধু থালা-ঘণ্টা বাজাতে বলবে। এই তিন মাসে যখন অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবন এ ভাবে উথালপাথাল হয়ে গেল এবং এখনও হচ্ছে, আমরা কিন্তু ভারতের শ্রমমন্ত্রীর মুখও দেখিনি। তাঁর কোনও বাণী বা উক্তি বা উপদেশও শুনতে পাইনি। যথেচ্ছাচারের একটা সীমা থাকা উচিত।
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, কেন্দ্র ইচ্ছেমতো তার সাংবিধানিক কর্তব্য আর একটি বিশেষ আইনের দায়িত্বকে সুদক্ষ ভাবে অস্বীকার করল, এবং পছন্দের অন্য একটি আইন বহাল তবিয়তে প্রয়োগ করল। দ্বিতীয় আইনটি হল ২০০৭ সালের ‘ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ বা বিপর্যয় মোকাবিলা আইন। এই আইনটি দেখিয়ে রাজ্য সরকার ও সাধারণ নাগরিকের ওপর লাঠি ঘোরানোর ক্ষমতা প্রদর্শন করল মোদী সরকার। সেই আইনের এতই শক্তি যে এক উচ্চপদস্থ আমলা— কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব— বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীদের শাসন করতে শুরু করলেন। তাতে যদি পরিযায়ী মজুরদের বিন্দুমাত্র উপকার হত, তা হলেও তা মেনে নেওয়া যেত। সেটা হল না। মার্চ মাসে তাঁদের সমস্যাটাকে উপলব্ধি করে যদি ত্রাণ আর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করত প্রশাসন, তবে অনেকগুলো প্রাণ বাঁচত।
চার দশকের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়, তখনই যদি কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি বোঝাপড়া করে এই শ্রমিকদের আশ্রয়, খাবার আর হাতে কিছু টাকা দিতে পারত, তা হলে বেশির ভাগ শ্রমিক যে রাজ্যে ছিলেন, সেখানেই থেকে যেতেন। ভারতের ওই স্তরের আধিকারিকরা ত্রাণ দিয়ে আর ক্যাম্প চালিয়ে এতই অভ্যস্ত যে এই আকারের বিপর্যয় নিশ্চয় এড়ানো যেত। অন্য দিকে, ভারতীয় রেল প্রতি দিন ২.৪ কোটি যাত্রী বহনের ক্ষমতা রাখে, আর তার সঙ্গে যদি ঠেকায় পড়ে কিছু মালগাড়িও ব্যবহার করে, তবে এক সপ্তাহে প্রায় ২০ কোটি লোককে ঘরে ফেরাতে পারত। পাশাপাশি, ভোটের সময় যে ভাবে বাস ও ট্রাক কাজে লাগানো হয়, তেমনটা করলে এক সপ্তাহে ৩০-৩২ কোটি লোককে ঘরের কাছাকাছি এগিয়ে দেওয়া অসম্ভব ছিল না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে মার্চের শেষে এবং এপ্রিলের গোড়ায় সংক্রমণ তত ছড়ায়নি, বা এই রকম ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেনি।
আসলে ব্যাপারটা হল যে প্রশাসন শুধু কথা দিয়ে চলে না। অভিজ্ঞতা, পরামর্শ আর টিমওয়ার্কের বিশেষ প্রয়োজন। সঙ্গে একটু সহানুভূতি। ২৫ মার্চ যখন মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে নরেন্দ্র মোদী তাঁর নাটকীয় ভঙ্গিতে হুকুম জারি করলেন, তখন কিন্তু এতগুলো প্রয়োজনীয় সুচিন্তার একটারও চিহ্ন আমরা দেখিনি। পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল দেশে বিশ্বের সবচেয়ে কড়া লকডাউন জারি করার আগে কোনও আলোচনাই তিনি করলেন না। কোনও মন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েছিলেন কি না জানা নেই, তাঁর ধারেকাছে কাউকে দেখা যায়নি। এ কথা বহুলপ্রচারিত যে, মোদী মন্ত্রীদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সচিবদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। আবার, একটু অপছন্দ হলেই তাঁদের রাতারাতি সরিয়ে দেন। এক ছোট্ট প্রভুভক্ত গোষ্ঠী দিয়ে খামখেয়ালি মেজাজে দেশ চালান। কেউ মন খুলে উপদেশ দেয় না, বা সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না। তা সত্ত্বেও এত বড় পদক্ষেপ করার আগে তিনি যদি তাঁর পছন্দের সচিবদের সঙ্গেও একটু খোলা মনে কথা বলতেন, তাঁদের মধ্যে কেউ না কেউ পরিযায়ীদের কথাটা তুলতেন। সকলেই এত ভীত-সন্ত্রস্ত নন। এক জন হলেও নিশ্চয়ই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই দিনমজুর এবং তাঁদের পরিবারের কথা তুলতেন।
এই কথা ইতিহাস কখনও মানবে না যে এই ভিন্ রাজ্যে কাজ করা মানুষদের কথা সরকার জানত না বা বুঝতে পারেনি। শহরে বা গ্রামে সাধারণ মানুষরাও এই শ্রেণির পুরুষ ও মহিলাদের চেনেন। সুতরাং, ভারত সরকারের শীর্ষে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের না চেনার কোনও কারণ খুঁজে পাই না। এলাকার অনেকেই জানেন, বহিরাগত শ্রমিকদের মধ্যে বড় সংখ্যার মানুষ প্রচুর দূর থেকে এসে রুজি-রোজগারের দায়ে এখানে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। এঁদের নিয়েই তো সমস্যা। থানার অফিসার কনস্টেবল থেকে পঞ্চায়েত বা পুরসভার জনপ্রতিনিধি আর নিম্ন স্তরের কর্মচারীরা মোটামুটি সকলেই এঁদের চেনেন। কিন্তু বিপদের সময় হঠাৎ সরকার বাহাদুর গান্ধারীর মতো চোখের ওপর পট্টি বাঁধায় সবারই সত্যি অবাক লাগল। লকডাউনের সময় কয়েক দিন পর পর যে বিরাট বিরাট সরকারি আদেশনামা বেরোল, সেখানে এই অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে তেমন কোনও উল্লেখই ছিল না।
ভারত সরকারের রিপোর্টের ভুলভুলাইয়ায় প্রবেশ করলেই এই অসংগঠিত শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে শত শত দিস্তা বাঁধানো কাগজ হাতের নাগালে পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে অর্থনীতিবিদ অর্জুন সেনগুপ্তর কমিটি এক বৃহৎ রিপোর্ট দিয়েছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে, যার নাম ‘কন্ডিশনস অব ওয়ার্ক অ্যান্ড প্রোমোশন অব লাইভলিহুডস ইন দি আন-অর্গানাইজ়ড সেক্টর’। সেনগুপ্ত কমিশন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় অর্ধেক আসে এই অসংগঠিত শ্রমিদের কাছ থেকে, আর ভারতে সম্পূর্ণ কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশ এই শ্রেণির অবদান।
অর্জুন সেনগুপ্ত অবশ্য এই শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে পৃথক করে নির্দিষ্ট করতে পারেননি যে ঠিক কত মানুষ বাইরে বা অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যেতে বাধ্য হন। তার পাঁচ বছর পরে জাতীয় পরিসংখ্যান আয়োগ রাধাকৃষ্ণ কমিটির গবেষণা গ্রহণ করেন, যাতে এই শ্রমিকদের বিষয়ে প্রচুর মূল্যবান তথ্য আছে। এর পরে আরও অনেক পণ্ডিত ও আমলারা এই বিষয় নিয়ে পরীক্ষা, অনুসন্ধান ও আলোচনা করেছেন। লকডাউনের পর যখন এত মানুষের সর্বনাশ হল, তখন কেন্দ্রীয় সরকার মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকল কী করে?
এ বার মনে হয় দেশের সুপ্রিম কোর্ট জেগে উঠেছে। আর আমরা অবশেষে আশায় বুক বাঁধছি যে আদালতের নির্দেশ মানা হবে।