নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলকে যেরকম তড়িদগতিতে নিয়োগ করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শীর্ষ আদালতও। মোদি জমানার আরও কীর্তি ‘সুপ্রিম’ প্রশ্নের মুখে। লিখছেন সাংসদ জহর সরকার
য যেরকম দ্রুততার সঙ্গে অরুণ গোয়েলের নিয়োগে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, এই বাহ্য, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলি নির্দেশে যেভাবে বিদ্যুৎ গতিতে এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে, সেটা এককথায় তুলনারহিত। তাবৎ পরম্পরা এবং প্রতিষ্ঠিত নীতিসমূহ পরাস্ত হয়েছে এই দ্রুততার কাছে। অরুণ গোয়েল কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদে ইস্তফা দেন। ইস্তফাদানের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিজিলেন্সের ছাড়পত্র পান আর প্রধানমন্ত্রী সেই পদত্যাগ পত্রটি সঙ্গেসঙ্গে অনুমোদন করেন। অন্যদের চাকরির নথি ঘেঁটে অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধার জাবেদা-খতিয়ান প্রস্তুতিতে যেখানে কেয়কদিন কেটে যায়, সেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শ্রী গোয়েলের পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড-সহ তাবৎ বকেয়া প্রদানের ব্যবস্থা হয়ে গেল এক ঘণ্টার মধ্যে। এটা আরও বিস্ময়জনক বলে প্রতীয়মান হয় যখন দেখি শ্রীগোয়েলের চাকরির মেয়াদটি বড় কম ছিল না। তিনি দীর্ঘ ৩৬ বছর সরকারে চাকরি করেছেন, কখনও রাজ্যে কখনোবা কেন্দ্রে।
এর খানিকক্ষণের মধ্যে অরুণ গোয়েলের নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়েগ সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরী হয়। আর অন্যদের ক্ষেত্রে যেখানে ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর রিপোর্ট পেতে মাস কাবার হয়ে যায়, এই ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ এসে যায়। এই পদের জন্যে অন্য কোন যোগ্য আধিকারিকের নাম চিন্তা করা হয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রথমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোয়েলের নামই অনুমোদন করেন তারপর প্রধানমন্ত্রী ফাইলে স্বাক্ষর করেন। এসব কিছুই সম্পন্ন হতে সময় লাগে মাত্র কেয়কটা ঘণ্টা।
গণতন্ত্রে কোনও সরকারি বিষয় কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, যদিও কোনও কোনও ব্যক্তি পছন্দের লোককে পছন্দসই পদে বসাবার জন্য তেমন আচরণই করে থাকেন। কিন্তু সেক্ষেত্রও নিযুক্ত ব্যক্তির যোগ্যতাটি নিয়মমাফিক হওয়াটা অতি অবশ্যক। যার নামই প্রস্তাব করা হোক না কেন শুরু হয় আইনের বিশ্লেষণ আর ধাপে ধাপে পরীক্ষা নিরীক্ষা ।
এক্ষেত্রে গোয়েলের নির্বাচন কমিশনারের উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একটি সাংবিধানিক পদে নিয়েগ অত্যন্ত দৃষ্টিকটু দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েচে। সাধারণত আমলাতন্ত্রের নিজস্ব শ্লথতার কারণে এধরণের নিয়োগে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তাতে ভাল মন্দ অনেক কথা বেরিয়ে আসে। কিন্তু ‘চোখের পলক পড়তে না পড়তে’ যেভাবে অরুণ গোয়েল নিযুক্ত হলেন সেটা বেশ সন্দেহ জাগায়। সেটাই এবার সুপ্রিম কোর্টের নজরে এসেছে। এবার শীর্ষ আদালতের তদন্তেই দেখা যাক, আলোচ্য নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব ছিল না কি ছিল না।
সরকারি আধিকারিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েক কিলো কাগজে নিয়ম লেখা আছে। বিচার পরীক্ষা আর নথি তৈরি তো শেষ নেই । সে ক্যাবিনেট সচিবের কুরসী হোক বা সাধারণ অ্যাসিস্ট্যান্টের পদ হোক না কেন পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা আর নথি করা হয় — সব পদের ক্ষেত্রে এমনটা নিয়ম। এটাই এদেশের প্রথা। খুঁটিনাটি সব দেখে, চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের পর, প্রার্থীর যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত যাবতীয় রিপোর্ট খতিয়ে দেখে তবে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে তাঁর চূড়ান্ত মতামত জানান। সেটা জানার পর সব মহল তৎপর হয়ে ওঠে। এমনটাই এদেশের পরনিয়ম।
প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার প্রথম দিনটিতেই নরেন্দ্র মোদি কে বলা হয় যে তিনি চাইলেও নৃপেণ মিশ্রকে তাঁর প্রধান যসচিব হিসেবে পাওয়া মুশকিল কেননা সেক্ষেত্রে আইন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় দিনেই অধ্যাদেশ জারি করে সংসদীয় আইনটাকেই বদলে দেন। এরকম প্রধান ভাঙা কাজ তাঁর জমানায় তিনি বহুবার করেছেন। চাকরি জীবনের শেষ দিনে কে জয়শঙ্করের বিদেশ সচিব পদে আসীন হওয়াটাও ছিল নাটকীয়তায় ভরা একটা চমক। আগেভাগেই এই কাজটি করা যেতে পারত। কিন্তু ‘নাটুকে’ মোদি জয়শঙ্করের বিদায় সংবর্ধনার দিনটাতেই পুষ্পস্তবক প্রদানকালে সচিব হিসেবে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার চিত্রনাট্যটিই রচনা করেছিলেন। অনুরূপভাবে গুজরাতের সতীশ ভার্মা ইসরাত জাহান হত্যা মামলায় বরিষ্ঠ আধাকারিকদের দিকে অভিযোগের তর্জনি তোলার হিম্মৎ দেখিয়েছিলেন আর সেজন্য অবসর গ্রহণের আগে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হয়।
বহুবছর আগে সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি মুখ খুলেছিলেন, এই অপরাধে তিনি বরখাস্ত হন। এসব ঘটনা একটা সত্যের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। সেটা হল, মোদি-শাহ জুটি যেন তেন প্রকারেণ যা চান সেটাই করতে বদ্ধপরিকর।এমনটা নয় যে মোদি জমানার আগে এমনটা কোনওদিন হয়নি। এ ঘটনা অভূতপূর্ব, তা কিন্তু নয়। কিন্তু এত দ্রুততা, এত তড়িঘড়ি নিয়োগ এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এই জমানায় যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরম্পরার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে সবকটি প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড, যাতে সবাই ‘হাঁ হুজুর’, জি হুজুর’-এর দলে নাম লেখায়। মনে হয় নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা আগেই নেওয়া হয়েছিল। পরে সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে। স্মর্তব্য, নির্বাচন কমিশনার শুধু গুরুত্বপূর্ণ পদ ই নয়। সাংবিধানিক পদ। সেজন্যই নৈতিক বিষয় কেবল নয়, আরও অনেক দিন আলোকিত হতে পারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের সৌজন্যে।
যে প্রগাঢ় অন্ধকার ঢেকেছে চারিদিক, তাতে প্রদীপ শিখাও এখন সমধিক গুরুত্বের দাবিদার, আর অন্ধকারের এই প্রসৃতিতে বিচারবিভাগীয় ভূমিকা সমুদ্র তীরের বাতিস্তম্ভের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম।