বিজেপিশাসিত অন্যান্য রাজ্যেও...সেখানকার অনেক শ্রমিক জানিয়েছে, কেবল বাংলায় কথা বলার জন্য এবং ভারতীয় হওয়ার সমস্ত প্রমাণ না-থাকার দায়ে জন্য তাদের যারপরনাই উত্যক্ত করা হয়েছে। হয়তো তাদের সব কথা সত্যি নয়, কিন্তু জনমানসে ক্ষোভ উদ্রেকের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। অন্য কোনও ভাষা-গোষ্ঠী (যেমন, কন্নড় বা ওড়িয়া) এই ধরনের নিয়মতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ সহ্য করতে পারবে? এই যে বৈরী মনোভাব, তার প্রধান কারণ তো বিজেপির হতাশা। যে. এত কাঠখড় পুড়িয়েও পশ্চিমবঙ্গ দখল করা যাচ্ছে না কেন! এত ক্যাম্পেন, এত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির পরও চিড়ে কেন ভিজছে না, তা জানতে মরিয়া মোদি এবং শাহ।

এমন অনেকে রয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় যাঁরা গুরুত্ব দিতে চান না, কিন্তু যখন বিজেপির বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে সমূলে বিনাশ করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, তখন কিন্তু তাঁর কথায় আমল না-দিয়ে তাঁদের আর উপায় রইল না। একমাথা বর্ষায়, ২১ জুলাই, কলকাতার কেন্দ্রস্থলে হাজার-হাজার অনুরাগী সমর্থক তথা বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। এরপর রবি ঠাকুরের বোলপুর থেকে হিন্দি ভাষার সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের বিরুদ্ধে শুরু করলেন 'দ্বিতীয়' ভাষা আন্দোলন। প্রথম' ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে মহম্মদ আলি জিন্না যখন পূর্ব পাকিস্তানের উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কেননা তাঁর চোখে বাংলাভাষী মাত্রই 'অভদ্র'। এর জেরে ২১ ফেব্রুয়ারি ৪ জন মারা যান, তাঁরা 'ভাষা শহিদ'। ১৯৭১ সালে, ভাষার অধিকার ও জাতিসত্তার পরিচয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে, বাংলাদেশে যে-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার জেরে ৩ লক্ষেরও বেশি গণহত্যা সংগঠিত হয়, এবং ২ লক্ষেরও বেশি বাঙালি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।

অন্যান্য রাজ্যে বাংলাভাষীদের উপর নির্যাতন, গ্রেফতার, এমনকী নির্বাসন পরোয়ানা জারি হওয়ার কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। অথচ, এই বৈমাতৃক মনোভাবের প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সর্বৈবভাবে উদাসীন। আরও আশ্চর্যের, জাতীয় গণমাধ্যম কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা দ্বারা এতখানি প্রভাবিত যে, তারাও অবলীলায় এড়িয়ে গেল এমন একটি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যেন এত বড় দেশে হঠাৎ উদ্ভূত উপ- জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণ মাত্র। এই প্রসঙ্গ ধরে, অতীতে ঘটা উপেক্ষিত অথচ সহিংস কিছু আঞ্চলিক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত স্মরণ করা যেতে পারে। ছয়ের দশকে পাঞ্জাবি সুবা আন্দোলনের সময় পাঞ্জাব কেঁপে ওঠে গুরুতর আন্দোলনে, এর জেরে পরে পৃথক শিখভূমের দাবিতে নিহত হন জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। খালিস্তান আন্দোলনের জেরে মাথাচাড়া দেয় সন্ত্রাসবাদ, স্বর্ণমন্দিরে সংগঠিত হয় 'অপারেশন ব্লুস্টার'- যার পরিণতি আবার ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা! অসম ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যেকেও দেখেছি একইভাবে উত্তপ্ত হয়ে পড়তে-যতক্ষণ না কেন্দ্র আপস করে। তামিলভূমে হিন্দির বাড়বাড়ন্ত রুখতে মাঝে মাঝেই সংগঠিত হয় আন্দোলন। শ্রীলঙ্কাও একাধিকবার জ্বলে উঠেছে তামিল ইস্যুতে- যার ফল- ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর গুপ্তহত্যা। শিবসেনার মুম্বইও সাতের দশকে দক্ষিণ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, চারিদিকে এত অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়িয়ে পড়লেও বাংলা কখনও বাঙালি উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতি দ্বারা লালিত বা উৎসাহিত হতে চায়নি। যখন অসমে বাঙালিদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার চলে, এমনকী, তখনও নয়। ওড়িশায় বাংলা-বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিচ্ছে অথচ এরপরও কোনও ওড়িয়াভাষীকে 'ম্যানমার্কিং' করা হচ্ছে না এখানে। কিন্তু প্রশ্ন হল- কত দিন! সব ধৈর্যের তো শেষ আছে। ধরুন, যদি একবার বাংলায় আঞ্চলিক উগ্র-জাতিসত্তা চাগাড় দিয়ে ওঠে, নিশ্চয়তা আছে কি ভিনরাজ্যের মতো এখানেও জনমানসে 'অপরাধমূলক মানসিকতা'-র উদ্ভব ঘটবে না? নিরীহ বহিরাগতদের উপর সহিংস অত্যাচার করা হবে না? ভুলে গেলে চলবে না-অন্যান্য রাজ্যের প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ বাস করে এই বাংলায়- তার সিংহভাগ আবার রাজধানী শহর কলকাতায়।
বাংলার নবজাগরণের ২০০ বছর অতিক্রান্ত। তারপরও বেশিরভাগ বাঙালি-মনে এখনও মূল্যবোধের সঞ্চার বহাল- যা নিঃসন্দেহে জাতিভেদ, গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক বিষ ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তাই হয়তো আপাতত খানিক নিশ্চিন্তি। কিন্তু ১১ বছর ধরে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক প্রচারণার পরে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় টানা মিথ্যে ও অর্ধ-তথ্যের মাধ্যমে, সভ্যতা সংস্কারের যে-হিড়িক উঠেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এবং এই মিথ্যাপ্রচার যারা করছে উদ্বেগজনকভাবে তারা মূলত- উচ্চশ্রেণির ও সুশিক্ষিত। তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘৃণা করতে-করতে নিজেদের অজান্তে মুসলমানবিদ্বেষী হয়ে পড়েছে। এই প্রবণতাও কিন্তু কম চিন্তার নয়। বাঙালি নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্নেহশীল। হয়তো একটু বেশিই আবেগপ্রণ। তারই প্রতিফলন-১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গে বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া এবং পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি জাতি সংঘ দ্বারা 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে স্বীকৃতি লাভ। বেশিরভাগ বাঙালি অসাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু হালে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত বাংলাদেশিকে 'অবৈধ' বলে দাগিয়ে যে পদ্ধতিগত ও সমন্বিত অভিযান শুরু করেছে, তাতে যে কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটা স্বাভাবিক। 'অবৈধ বাংলাদেশি' খুঁজে বের করা যেন-বা একটি কেন্দ্রচালিত উদ্যোগ। পশ্চিমবঙ্গের পরে তাই কেরল, পাঞ্জাব এবং তামিলনাডুতেও পুলিশি অভিযান শুরু হয়েছে। তবে এখানে, বিজেপিশাসিত রাজ্যের মতো, ইসলামোফোবিয়া বিদ্বেষের মূল কারণ নয়। এ সমস্ত রাজ্যে 'অবৈধ বাংলাদেশি' বলে বাঙালি খেদানো হচ্ছে- কারণ ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিরা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে অবৈধ বা বৈধ অভিবাসী, হিন্দু হোক বা মুসলমান, আইনি পরিচয়পত্র থাকুক বা না-থাকুক, ভারতীয় হোক বা জাল পরিচয়পত্র-সহ বাংলাদেশি, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক হোক বা বাংলাদেশি শ্রমিক-বাংলাভাষী মানেই 'বহিরাগত'। পহেলগাঁও ঘটনার পরপরই গুজরাতে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের কলোনি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। 'অবৈধ' বলে দাগিয়ে দিয়ে, এবং কোনও তথ্যপ্রমাণকে আমল না-দিয়ে, ২৬ এপ্রিল, ৮৯০ জনকে (তার মধ্যে ২১৯ জন মহিলা এবং ২১৪ জন শিশু) তুলে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা হয়। পরে দেখা যায়, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ভারতীয় 'বাঙালি' এবং 'বৈধ' পরিচয়পত্রর অধিকারী। দিল্লিতেও এক ছবি। সুপ্রিম কোর্টের রায় মোতাবেক সেখানকার বাঙালি বসতি নাকি 'অবৈধ'। হাই কোর্ট এই অভিযান বন্ধ করার ক্ষেত্রে ঠুটো জগন্নাথ-সম। শুধুমাত্র দিল্লির একটি স্থানীয় আদালত, তুলনামূলক কঠোর মনোভাব দেখিয়ে, বাঙালি পরিযায়ীদের একটি বস্তি- 'জয় হিন্দ কলোনি'- ভাঙার অভিযান স্থগিত রাখতে পেরেছে। ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্টের তরফে ওড়িশা সরকারের কাছেও রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে- পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের উপর কেন নির্যাতন হচ্ছে- তার কারণ জানতে। স্পষ্টত, এই রাজ্যের মানুষ হরিয়ানায় পুলিশি নির্যাতনের ভিডিও দেখে হতবাক। তারা অবাক গুরুগ্রামের জেল তথা 'হোল্ডিং সেন্টার'-এ মানুষের আটকে থাকার ভয়াবহতা সম্পর্কিত প্রতিবেদন পড়েও যাদের একমাত্র অপরাধ- তারা বাংলায় কথা বলে!

বিজেপিশাসিত অন্যান্য রাজ্যেও অবস্থাও তথৈবচ। সেখানকার অনেক শ্রমিক জানিয়েছে, কেবল বাংলায় কথা বলার জন্য এবং ভারতীয় হওয়ার সমস্ত প্রমাণ না-থাকার দায়ে জন্য তাদের যারপরনাই উত্যক্ত করা হয়েছে। হয়তো তাদের সব কথা সত্যি নয়, কিন্তু জনমানসে ক্ষোভ উদ্রেকের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। অন্য কোনও ভাষা-গোষ্ঠী (যেমন, কন্নড় বা ওড়িয়া) এই ধরনের নিয়মতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ সহ্য করতে পারবে? এই যে বৈরী মনোভাব, তার প্রধান কারণ তো বিজেপির হতাশা। যে. এত কাঠখড় পুড়িয়েও পশ্চিমবঙ্গ দখল করা যাচ্ছে না কেন! এত ক্যাম্পেন, এত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির পরও চিড়ে কেন ভিজছে না, তা জানতে মরিয়া মোদি এবং শাহ। অর্থেরও কম বন্যা তো তাঁরা বইয়ে দেননি। আদতে ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে যখন ভারত কোভিডে জেরবার, তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তাঁদের নেতৃত্বে খামতি থেকে গিয়েছে বইকি। সেই অবহেলার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। তবে মোদি না ভোলেন, না ক্ষমা করেন- ঠিক যে-কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার জোর দিয়ে বলেন যে, কেন বাংলা প্রধানমন্ত্রীর চক্ষুশূল। কারণ, তিনি নিজের পরাজয় মেনে নিতে পারেন না, ফলে ক্রমশ তিনি হয়ে পড়েছেন 'বাঙালি বিদ্বেষী'। এদিকে, মোদির রোষ খানিক প্রশমিত করার জন্য অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মতো প্রধানমন্ত্রীর যাঁরা অনুরাগী ও অনুসারী- তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যান- কীভাবে তোষামোদ করা যায় নানা হাস্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে। যেমন, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটার রাজবংশী বাসিন্দা উত্তমকুমার ব্রজবাসীকে 'অবৈধ' অভিবাসী বলে চিহ্নিত করে একটি সম্পূর্ণ অন্যায্য 'এনআরসি' ('জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন') নোটিস জারি করা হল। মুশকিল হল, হিমন্ত তাঁর 'গুরু'কে খুশি করতে গিয়ে পড়লেন জনরোষের আঁচে। অবশ্য তাতে তিনি দমে যাওয়ার বান্দা নন। এখনও অসমে আকছার একে-তাকে 'এনআরসি' ধরিয়ে দেশছাড়া করার প্রচেষ্টা বহাল। এই রাজ্যে বা অন্যান্য রাজ্যে বসবাসকারী সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি, দরিদ্র বাঙালি, যারা পরিযায়ী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রভাবিত হয়নি, তারা দু'টি কারণে ক্ষুব্ধ। প্রথম, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি- বিরোধী বৈরী মনোভাব। এবং দ্বিতীয়, 'অবৈধ' বাংলাদেশিরা, যারা সমস্যার মূল কারণ। অস্বীকার করা উপায় নেই যে, সন্দেহভাজন কিছু 'অবৈধ'বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তবে এখন পর্যন্ত সেই প্রাপ্ত সংখ্যা তেমন ভয়ংকর নয়। প্রসঙ্গত, শয়ে-শয়ে বাঙালিকে অকারণে হেনস্তা করার পর, মহারাষ্ট্রের পিম্পরি-চিঞ্চওয়াড় পুলিশ ভারতে 'অবৈধভাবে' বসবাসকারী মাত্র ৬ জন বাংলাদেশিকে শনাক্ত করে তাদের বহিষ্কার করতে পেরেছে। দরিদ্র বাঙালি পরিযায়ীদের উপর ভারতজুড়ে নির্যাতনের পর গত দু'-মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশ থেকে মাত্র ১৫০০ 'অবৈধ' অভিবাসীকে বাংলাদেশে পাঠানো গিয়েছে (যেহেতু অমিত শাহের মন্ত্রিসভা পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে না, তাই আন্তর্জাতিক সংস্থা, 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' থেকে এই সংখ্যাটি সংগ্রহ করা)। আর, কেন্দ্রের ধামাধরা জাতীয় গণমাধ্যম আগের মতোই এখনও উদাসীন। মনে করা হচ্ছে-নির্বাসিত বাংলাদেশির সর্বাধিক সংখ্যা ৪ হাজারের মধ্যে, এবং তাদের মধ্যে অনেককে ভারতে ফিরিয়ে আনতে হয়- কারণ তাদের পরিবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করে। তাহলে এই যে আমরা শুনছি লক্ষ-লক্ষ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা ভারত দখল করল বলে? সে কথা কি মিথ্যে? আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল 'র‍্যাডক্লিফ সীমানা', যা দুই বাংলাকে পৃথক করে, তা মারাত্মকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। পাঞ্জাবে আমরা এই ধরনের সমস্যার কথা কিন্তু শুনি না, পাঞ্জাবের একটি অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও। বাংলার বাইরে অনেকেই 'হিন্দু বাঙালি' ও 'মুসলমান বাঙালি'-র কী তফাত এবং কেন, তা ঠাহর করতে পারে না। তার মধ্যে খাঁড়ার ঘা: ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার। যদি কোনও ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে (পাঞ্জাব এবং কাশ্মীর বাদে- যেখানে এখনও ক্ষত রয়েছে) দু'টি ভাগে বিভক্ত করা হয়, তবে এই একই সমস্যা যে কোনও জায়গায় দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। যারা বাংলা জানে না, তাদের পক্ষে উচ্চারণভেদে কারা 'ভারতীয়', কারা 'বাংলাদেশি' তা নিশ্চিত করে বলাও প্রায় অসম্ভব। কারণ, দু'-দেশের ভাষা ছাড়া মৌলিক খাবারও এক ও অভিন্ন। রন্ধনশৈলী অঞ্চল অনুসারে আলাদা হয় হয়তো, কিন্তু সেখানে ধর্মের কোনও হাত নেই। তাছাড়া, বিজেপির চোখে 'অবৈধ বাংলাদেশি' মানে কেবলই মুসলমান। সে কারণে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যত দ্রুত সম্ভব নাগরিকত্ব আইন ই সংশোধনী বিল পাস করতে মরিয়া। এদিকে, তিনি অবশ্য মতুয়া এবং বাংলার অন্যান্য অভিবাসী বা শরণার্থীদের নির্ঝঞ্ঝাট নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন আগেভাগে। পরিবর্তে, তারা বিজেপিকে ২টি লোকসভা সাংসদ এবং প্রায় ৮-৯ জন বিধায়ক দিয়েছে অগ্রিম উপঢৌকন হিসাবে। তবে মুসলমান-বিদ্বেষী মনোভাবটি অমিত শাহ প্রকাশ্যে আনেন না।

পশ্চিমবঙ্গের আনুমানিক ১০ থেকে ১০.৫ কোটি জনসংখ্যার (ধরে নিই, ১০ কোটি), প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ বাংলাভাষী নয়। ২০১১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায়, ভারতের বাংলাভাষীদের প্রায় ২০ শতাংশই ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকে। এর অর্থ, মোট ১২ কোটি বাঙালির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকে ২ থেকে ২.৫ কোটি। অসমে জনসংখ্যার ৩.৬ কোটির মধ্যে কমপক্ষে ১.৪ কোটি বাঙালির বাস (বেশিরভাগই মুসলিম)। বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে, অসম বহু শতাব্দী ধরে 'বঙ্গ প্রদেশ'-এর অংশ ছিল পরবর্তীতে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে অসমের সঙ্গে একীভূত করা হয়। ফলে, সেখানকার বিপুল সংখ্যক বাঙালি এবং অহমিয়ারা আশঙ্কিত তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে-যতক্ষণ না 'বহিরাগত' বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের তরফে যুক্তিযুক্ত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাকি প্রবাসী বাঙালির একাংশ ত্রিপুরা, আন্দামান-নিকোবরের পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে- স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে, অথবা অস্থায়ী পদে অথবা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গের ১০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে, যার মধ্যে বাঙালি এবং অবাঙালি মিলিয়ে (উর্দুভাষীদের একটি বৃহৎ অংশ রয়েছে) প্রায় ২.৮ থেকে ৩ কোটি মানুষ মুসলমান। এই রাজ্যের এই 'বাঙালি ভারতীয় মুসলিম'-রা হালে বিজেপির প্রধান চক্ষুশূল। কারণ, অনুমেয়, তারা প্রায় কেউ-ই বিজেপি ভোটার নয়। সমস্যাটি আরও তীব্রতর হয়েছে- কারণ এদের অনেকেই- অন্তত বছরের বেশিরভাগ সময় বাংলার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়। বঙ্গে শিল্পায়ন এখনও প্রখরভাবে ডানা মেলতে পারেনি, দীর্ঘ দিন ধরে 'লাল'-কে ভোট দেওয়ার পর, এবং বিজেপি গত কয়েক বছর যাবৎ শুধুমাত্র এই রাজ্যেরই গ্রামীণ উন্নয়ন (বিশেষ করে NREGA) তহবিল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ফলে, বেকারত্বের জ্বালায় শ্রমিকদের অন্যত্র কর্মসংস্থান খুঁজতে হচ্ছে। এই হতদরিদ্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম- যারা এখন 'বাংলাদেশি' বলে চিহ্নিত। কিন্তু হিন্দিকেন্দ্রিক বিজেপি বাঙালির উপর এত খাপ্পা কেন? প্রথম কারণ, এটি এখনও ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা গোষ্ঠী। ১২ থেকে ১২.৫ কোটি ভারতীয় বাংলায় কথা বলে। দেশভাগের আগে, বাংলভাষীরা এখনও পর্যন্ত, আদি হিন্দিভাষী জনসংখ্যার পরে, উপমহাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছিল। এদিকে. হিন্দিভাষী হিসাবে ঠিক কাদেরকে ঠাহর করা যায় তা নিয়ে আদমশুমারিতে গোল বাধে কারণ- কেউ বলে আমরা হিন্দুস্তানি, কেউ বলে আমরা বিহারি- অথচ, তাদের সবার ভাষাই হিন্দি। ১৯৪৭সালের পর, বাংলা দু'টি জাতিতে বিভক্ত হয়ে যায়, কিন্তু হিন্দি তার সংজ্ঞাকে প্রসারিত করেছে এবং ভারতে তার ব্যবহারিক উপযোগিতাকে ২৩ শতাংশ থেকে ৪৩ শতাংশে উন্নীত করে ভোজপুরি, পাহাড়ি ভাষা, বুন্দেলি, রাজস্থানি ইত্যাদি ১৭টি ভাষাকে 'অন্তর্ভুক্ত' করে নিয়েছে- আবার কালে-কালে তারা প্রত্যেকে দাবি করছে যে, তাদের কথ্য ভাষাকে হিন্দির উপভাষা নয়, বরং 'স্বাধীন' ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

অনেকেই জানতে আগ্রহী, ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাভাষীর মোট সংখ্যা আদতে কত। যদিও বেশিরভাগ পরিসংখ্যান পরস্পরবিরোধী। প্রাপ্ত সূত্র অনুযায়ী, সংখ্যাটি প্রায় ২৯ কোটি। যা উপেক্ষা করা খুবই কঠিন। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত আদমশুমারি, যা ১৭০ বছরের পুরনো বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি- তা এখন রসাতলে, তাই আমাদের এআই নির্ভর সংস্থা 'গ্রোক ৪'-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৭ কোটি বাংলাভাষীর মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মুসলিম। যদি আমরা এই ১৭ কোটিকে ১২ কোটি ভারতীয় বাঙালির (প্রায় আড়াই কোটি মুসলিম) সঙ্গে যোগ করি, তাহলে আমরা মোট ২৯ কোটি বাংলাভাষী মানুষ। মজার আমরা ভুলে যাই যে, বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলা ভাষার প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল থেকেছে। সাধারণ বাঙালি পরিচয়' আন্তঃধর্মীয় পার্থক্যকে একত্র ও অপেক্ষাকৃত নরম করলেও-উভয় দেশেই উগ্র-সাম্প্রদায়িক মানুষ রয়েছে। বিশেষত, বাস্তুচ্যুত দাঙ্গা-ভুক্তভোগীরা মাঝে মাঝেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। বর্তমানে, বাংলাদেশে ইসলামি অসহিষ্ণুতার জেরে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত, বলা বাহুল্য, এই অসহিষ্ণুতায় প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে জামাতের, যেমন, এ-দেশে মেরুকরণে মদত দেয় বিজেপি। হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের বর্তমান পরিকল্পিত কৌশল, প্রত্যেক অভিবাসী ভারতীয় বাঙালি শ্রমিককে 'বাংলাদেশি' হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া, কারণ একমাত্র এই পথেই বিজেপি তথা হিন্দুত্বের জয়। বিজেপি অন্ধভক্তরাও এতে যারপরনাই খুশি- কারণ দল তাদের যাবতীয় হতাশা-ক্ষোভ উগরে দেওয়ার একটা সহজ পন্থা দেখিয়ে দিয়েছে- যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো করে মুসলমানদের শাপশাপান্ত করো, প্রয়োজনে দু'-ঘা দিয়ে দাও, তাতেই মন-মাথা সব ঠান্ডা। দশকের-পর-দশক ধরে বিজেপির নিরলসভাবে প্রচেষ্টা মানুষকে বোঝানো 'বাংলাদেশি'-রা হল উইপোকার জাত- এদের 'লক্ষ্য' ভারতের বিনাশ। প্রসঙ্গত, জানিয়ে রাখি, এই নিন্দনীয় 'উইপোকা' শব্দটি আমি ব্যবহার করছি না, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলায় বারবার পরাজয়ের কারণ দর্শাতে গিয়ে একবার উত্তেজিত হয়ে এ-কথা বলেন।

এবার একটা মজার কথা বলি শুনুন। আমেরিকান পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৪ সালে আমেরিকার 'অবৈধ' অভিবাসীদের অর্ধেক গুজরাতি। মাঝে মাঝে ভাবি, তিনি নিজের দেশ তথা নিজের রাজ্যের এই উইপোকাদের নতুন কী নাম দেবেন! বিজেপির বক্তব্য, 'বাংলা এতটাই অবৈধ বাংলাদেশি মুসলিমে ভর্তি যে তৃণমূল কংগ্রেসের থাবা থেকে এ রাজ্য নিজেকে বাঁচাতে পারল না। ভুয়া ভোটার নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের বড় ভোটব্যাঙ্ক। রাজনীতির স্বার্থেই এই অবৈধ অভিবাসীদের ব্যবহার করছে রাজ্য সরকার।' শুধুমাত্র বিজেপি সমর্থকরা দলের এই কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে নিয়েছে এমন নয়, তাঁবেদার সংবাদমাধ্যমও তাতে শামিল।

No comments on 'দেশ ও দ্বেষ'

Leave your comment

In reply to Some User