যাদবপুরের কলা বিভাগ ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্সিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, তবে এখনও তার ছায়া যাদবপুরের লিলিপুলে ঘোরাফেরা করে বলেই মনে হয়। এক দিকে আধিপত্যকামী সরকারি কর্তারা এবং অন্য দিকে বিদ্রোহী ছাত্র ও একগুঁয়ে শিক্ষক— এই দুই তরফের মাঝখানে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাঁসফাঁস করছেন। শোনা যায়, মাঝে মাঝেই নাকি তাঁদের ভর্ৎসনা করা হয়, কেন তাঁরা ‘প্রেসিডেন্সি মডেল’টি চালু করতে পারছেন না। কিন্তু ব্যয়বহুল প্রসাধন এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের মডেলটি ভারতীয় শিক্ষাজগতের স্বভাবসিদ্ধ নয়— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টাকাপয়সা কম থাকবে, শিক্ষক ও ছাত্ররা বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ হয়ে থাকবেন, এটাই এ দেশে নিয়ম, হয়তো কিছু ব্যতিক্রম আছে। রাজ্যে কলেজে ছাত্র ভর্তি সংক্রান্ত পরিচিত সমস্যাগুলি থেকে যাদবপুর অন্তত মুক্ত ছিল। সেখানে ভর্তি নিয়ে অশান্তিটা যেন চাপিয়ে দেওয়া হল। সাধারণ ভাবে কলেজে ভর্তি নিয়ে অশান্তির মূলে রয়েছে তোলাবাজি। ইউনিয়নের মাতব্বররা ভর্তির জন্য সরাসরি টাকা চাইছে, এটা আগে অন্তত এ ভাবে হত না।
কয়েক দশকের বাম শাসন এবং তার উত্তরপর্বে নিছক জনমনোরঞ্জনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষায় মধ্যমেধার যে দাপট প্রতিষ্ঠা করেছে, তা থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কিছুতেই বেরোতে পারছে না। উৎকর্ষের বদলে আনুগত্যকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে এই দুই জমানার মধ্যে আশ্চর্য রকমের সাদৃশ্য আছে এবং সেটা একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। শিক্ষকদের একটা বেশ বড় অংশ আগের আমলেও শাসকের অনুগত থেকে ক্ষমতা ভোগ করেছেন, শাসক পরিবর্তনের পরে টুক করে জার্সিটি বদলে নিয়েছেন, ক্ষমতা থেকে সরেননি। দেখে দুঃখ হয় যে, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে যে ‘প্রথম একশো’ বেছে নেয়, সেই তালিকায় আছে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। তারা আনুগত্যের পুরস্কারের চেয়ে মেধাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এই তালিকায় যাদবপুর আছে ষষ্ঠ স্থানে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্দশ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রম ৭৫, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬। প্রেসিডেন্সি তালিকায় নেই। এই অনুপস্থিতির নানা ব্যাখ্যা শোনা গিয়েছে, তবে শাসকের প্রতি আনুগত্য এবং শিক্ষণের উৎকর্ষের মধ্যে সম্পর্কটা যে বিপরীত, তা নিয়ে কোনও তর্ক থাকতে পারে না।
লক্ষণীয়, ১৯৭০-এর দশক থেকে প্রেসিডেন্সির ধারাবাহিক অধঃপতনের ফলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভ হয়েছিল। প্রেসিডেন্সির কিছু অসামান্য শিক্ষক সেখানকার দম-বন্ধ-করা পরিবেশে টিকতে না পেরে যাদবপুরে চলে যান। ইংরেজির মতো বিভাগগুলিকে তাঁরা সমৃদ্ধ করেছিলেন। পাশাপাশি, তুলনামূলক সাহিত্যের মতো বিভাগগুলিতে যাদবপুরের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকরা তো ছিলেনই। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের একটা বড় কারণ হল শিক্ষকদের স্বাধীনতা— স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা, পরীক্ষানিরীক্ষার স্বাধীনতা, উদ্ভাবনের স্বাধীনতা। কলা বিভাগের শিক্ষকরা এই শ্রেষ্ঠ বিভাগগুলির সঙ্গে এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চেষ্টা করেছেন। সেটা খুবই ভাল— লেখাপড়ায় রেষারেষি অতি উপকারী বস্তু। তবে এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, সব বিভাগ শিখরে পৌঁছতে পারেনি।
এখানে বলা দরকার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (এবং আরও বেশ কয়েকটি প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের) উৎকর্ষের পিছনে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার রীতি। এই পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা যাচাই করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-শেষের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি করা হলে রাজ্যের কী যে বিরাট লাভ হত, সেটা একেবারেই বোঝা যায়নি। যাদবপুরের শিক্ষকদের একাংশ প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার প্রায় বিসর্জন দিয়েই বসেছিলেন, স্পষ্টতই তাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাননি। শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক অনশন এবং কুৎসিত ঘেরাওয়ের মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাধিকার ফিরে পায়। যে শিক্ষার্থীরা প্রবীণ উপাচার্য এবং অন্য শিক্ষকদের বারংবার দীর্ঘ ও কষ্টকর অবরোধের মধ্যে নিক্ষেপ করেন, তাঁদের আচরণ নিশ্চয়ই সমর্থন করা যায় না। মনে রাখতে হবে, অনশনের জন্য শারীরিক সহিষ্ণুতা এবং মনের জোর দরকার হয় এবং ‘প্রতিপক্ষ’-এর উপর তার নৈতিক প্রভাব পড়ে, কিন্তু ঘেরাও হল বিদ্যায়তনের স্বাভাবিক নিরাপত্তা বলয়ের অপব্যবহার। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতোই, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ও পুলিশ প্রশাসনের নাগালের বাইরে বলেই স্বীকৃত হয়ে এসেছে। এই নিরাপত্তা সহজে আসেনি, এ জন্য সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনেক লড়াই করে, আক্ষরিক অর্থেই অনেক রক্ত ঝরিয়ে তা অর্জন করতে হয়েছে। সেই রক্ষাকবচের সুযোগ নিয়ে মাস্টারমশাইদের ঘেরাও করে রাখার রীতি কখনওই মেনে নেওয়া চলে না।
রাজ্যের উচ্চশিক্ষা সচিব হিসেবে অনেক দিন কাজ করার অভিজ্ঞতায় শিক্ষাজগতের কাজকর্ম সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়েছে, যে ধারণা খুব সহজলভ্য নয়। একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি— ছকবাঁধা সংগঠনগুলির থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিন্তাভাবনা ও আচরণ ভিন্ন গোত্রের। এবং রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পর্কে শিক্ষাজগতের একটা তীব্র এবং প্রকট বিরাগ থাকে। এটাও ঠিক যে, এর পাশাপাশি— কি কেন্দ্রে, কি রাজ্যে— খুব কাছ থেকেই দেখেছি, কী ভাবে কিছু শিক্ষক রাজনৈতিক ক্ষমতার পদলেহন করে অন্যায্য ভাবে পদোন্নতি বা পোস্টিং আদায় করেন এবং কী ভাবে তাঁরা ছড়ি ঘোরান। শিক্ষাজগতের সব মানুষই জাগতিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না, বিদ্যাচর্চা নিয়েই থাকেন— এমনটা কখনওই বলা যাবে না। এ কথাও মানতেই হবে যে, শিক্ষকদের একটি ‘এলিট’ গোষ্ঠী তাঁদের ঘন ঘন বিদেশ যাত্রার ফাঁকে ক্লাস নেওয়ার দায়দায়িত্বগুলোকে কোনও মতে গুঁজে দিয়ে কাজ চালান। কিন্তু তবু একটা বিষয়ে কোনও তর্ক থাকতে পারে না— কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারস্যাপার আমলা এবং মন্ত্রীদের থেকে শিক্ষকরা ভাল বোঝেন। আর, আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রসিদ্ধ কাঁকড়াবৃত্তির একটা সুফল আছে— মাস্টারমশাইদের পারস্পরিক ঈর্ষা কাউকেই নিজের দায়িত্বে ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করতে দেয় না, অবশ্য যদি না তিনি সম্পূর্ণ নীতিভ্রষ্ট এবং অহংসর্বস্ব হয়ে শয়তানের সঙ্গে চুক্তি করে সব রকম অনাচারই চালিয়ে যেতে পারেন!
সব মিলিয়ে বলা যায়, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে, ভুলভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে স্বশাসনের যে ব্যবস্থাগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয়েছে সেগুলি যাতে কার্যকর থাকে, সে জন্য শিক্ষাজগৎকে নিজের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। আমি মনে করি, বাইরের মাতব্বরির চেয়ে সেটা অনেক শ্রেয়। আর, এক জামা সকলের গায়ে হবেই বা কেন?