চলতি বছরের বাজেট অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদী সরকার ঘোষণা করল যে ২০২১-২২-এ বিলগ্নীকরণ মারফত ১.৭৫ লাখ কোটি টাকা জোগাড় করবে। যে সব জাতীয় সম্পদের উপর থেকে সরকারী নিয়ন্ত্রণ তুলে মোদী সংস্থা বিক্রি করতে চলেছেন তার মধ্যে আছে আই ডি বি আই ব্যাংক, ভারত পেট্রোলিয়ম, শিপিং কর্পোরেশন এবং এয়ার ইন্ডিয়ার মত বৃহৎ কোম্পানি। বলা বাহুল্য এর একটিও অবশ্য তাঁর তৈরি নয় কিন্তু কোন অধিকারে তিনি এগুলি বেচতে চলেছেন এই সব মৌলিক প্রশ্ন বা বিতর্ক তুলে সময় নষ্ট না করাই ভালো।
এই বিশাল বিক্রয় নীতি ঘোষণার চার মাস যেতে না যেতেই সকলকে অবাক করে মোদীর অর্থমন্ত্রী আর এক নূতন পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন। আগস্ট ২০২১-২২এর এই নীতি অনুযায়ী আরও প্রচুর জাতীয় সম্পদের বেসরকারীকরণ হবে নীলাম আর লিজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এর একটি গালভরা নাম-ও দেওয়া হয়েছে — ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন। এর মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন জাতীয় সম্পত্তি লিজ করে ২০২৪ - ২৫ সালের মধ্যে ৬ লাখ কোটি টাকা আয় করতে চায় । কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য এই বছরের মধ্যেই ৮৮,০০০ কোটি টাকা পেলে রাজস্ব ও বাজেট ঘাটতি কিছুখানি কম হবে। কিন্তু একই সাথে সরকার আবার ফলাও করে বলছে যে বিগত দুই মাসে জি এস টির থেকে তাদের রেকর্ড আয় হয়েছে মাসিক ১ লাখ ১০ হাজার কোটির ওপরে। পরস্পরবিরোধী দুটি তথ্যের ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে সত্য অনুধাবন করার চেষ্টা করছে।
কিন্ত এটা স্পষ্ট যে এই পরিকল্পনার "পাইপলাইন " টি দেশের সম্পদকে কিছু পছন্দের লোকের পকেটে ঢোকানোর একটি কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে মোদী দেশের ২০টি এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পত্তির বেসরকারীকরণ ও হস্তান্তর চিহ্নিত করেছেন — যার মধ্যে আছে রেল, বিদ্যুৎ ও সড়ক। বর্তমান নির্দেশ অনুযায়ী ভারতীয় রেল তার নিজস্ব সম্পদ যেমন রেল স্টেশন, প্যাসেঞ্জার ট্রেন, গুডস শেড, কোণকাণ রেল, পর্বত রেল, ও dedicated freight corridor প্রকল্প, সবই ব্যক্তিগত মালিকদের হাতে লিজে তুলে দিতে হবে। এমনকি ছোট শহরের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু রেল স্টেডিয়ামগুলিও অব্যাহতি পায়নি। বিদ্যুৎ খাতে মোদী বেসরকারীদের হাতে তুলে দিতে চলেছেন সুবৃহৎ ৬ গিগাওয়াট বা ৬ লাখ কোটি ওয়াটের হাইডেল ও সোলার (সৌর) সম্পদ যা সাধারণ মানুষ ও করদাতাদের টাকায় তৈরী হয়েছিল। এ ছাড়াও তিনি ১৬০ টি কয়লা প্রকল্প ও ৮০০০ কিলোমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন হস্তান্তর করতে চলেছেন। উল্লেখনীয় যে ২.৮৬ লাখ কিলোমিটার টেলিকম ফাইবার নেটওয়ার্ক ও ১৪,৯০০ টেলিকম টাওয়ার-ও মনিটাইজেশন এর আওতায় আসবে।
এর সাথেই আয় বৃদ্ধি প্রকল্পের প্রকোপ পড়বে দেশের ২৫টি বিমানবন্দরের ওপর, যেগুলি লিজে দেওয়া হবে ও এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়াতে সরকার নিজের অংশীদারিত্ব কমিয়ে বেসরকারী সংস্থাগুলির লাভের পথ প্রশস্ত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রধান ৯ বন্দরের ৩১টি প্রকল্প তৈরি করেছিল সেই কেন্দ্র সরকার যার নির্মম নিন্দা মোদী সর্বক্ষণ করতে থাকেন এবং এ সবই নিজের কুক্ষিগত থাকা পুঁজিবাদীদের হাতে তুলে দিতে চলেছেন। কে বা কারা লাভবান হবেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা কারণ তাঁর নিজের রাজ্যের পছন্দের শিল্পপতিরা সাম্রাজ্য বিস্তার করে বিমান ও বন্দর ক্ষেত্রেও গত পাঁচ বছরে অবিশ্বাস্য লাভ করেছেন। বেশীরভাগ মানুষ নিশ্চিত জানেন যে জনসাধারণের এই সম্পদ কানাকড়ির দামে কিনে এঁরা নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরও পোক্ত করবেন। এর পরেই তাঁরা বাজার দখল করবেন ও ঠিক করবেন ক্রেতাদের মূল্য। আমাদের আশঙ্কা এই সব জাতীয় সম্পত্তি আসলে নরেন্দ্র মোদীরই ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। দেশের অতি নগন্য মানুষও জানে টেলিকম সেক্টরের রাজা কে এবং এই পাইপলাইন প্রকল্পে সবচেয়ে লাভবান কে হতে পারেন। এই সব ধনকুবেরদের পেট্রোলিয়ম, বিদ্যুৎ ও পরিবহনেও স্বার্থ আছে অতএব এই পাইপলাইনের মারফত সরকারি কোষাগার থেকে সম্পদ সরাসরি ও দ্রুত গতিতে পৌঁছিয়ে দেওয়া যাবে।
এই সিদ্ধান্তে আসার আগে মোদী না নিয়েছেন সংসদের অনুমোদন আর না করেছেন রাজ্যগুলির সাথে পরামর্শ যেখানে এই সম্পত্তি অবস্থিত আছে। পঞ্চবর্ষিকী পরিকল্পনা তুলে দেওয়ার পর প্রধান মন্ত্রী শুধু তাঁর পোষা নীতি আয়োগের ওপরই ভরসা করেন আর এই সংস্থাটি তার নিজের অনুগামী ও চাটুকাররা-ই চালান। এঁরাই এই প্রস্তাব তৈরী করেছেন আর এঁরাই এখন আয়কর আইনের 54EC ধারায় কর মুক্ত করার জন্যে সওয়াল করছেন।এর অর্থ পুঁজিপতিরা এই বিলগ্নিকরণ থেকে শুধু মুনাফা-ই করবেন না, অনেক বিষয়ে তাঁরা করের-ও রেহাই পেতে পারেন।
মোদী এখন রাজ্যগুলিকে ও নির্দেশ দিয়েছেন যে তারা তাদের সম্পত্তির ফর্দ তৈরী করে নীলাম বা লিজ করে রাজস্ব আয় করুক। যদিও সরকার মুখে বলছে এই সম্পত্তি লিজে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেয়া হবে এটা স্পষ্ট করছেনা যে এই লিজের মেয়াদ বাড়ানো হবেনা যাতে পিছনের দরজা দিয়ে এই অমূল্য সম্পদ হস্তান্তরিত করা সম্ভব হয়। স্মর্তব্য, রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রের এখন বিক্রির তালিকায় থাকা সংস্থাগুলোর জন্যে জমি ইত্যাদি দিয়েছিলেন যাতে জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়ানোর জন্যে নয়।
এ কথা কারো অজানা নয় যে তাঁর দল নির্বাচনের জন্য অন্যান্য দলের থেকে অনেক বেশী পরিমাণ দান গ্রহণ করে থাকে। এখন মনে হচ্ছে তিনি সম্ভবত দাতাদের কৃতজ্ঞতার ফলস্বরূপ এই পরিকল্পনা তৈরী করেছেন। এই সব ফাঁস করার একমাত্র উপায় হলো লিজ নেয়া সংস্থাগুলিকে ঘোষণা করতে বাধ্য করা যে তারা বা তাদের পরিবারের এবং তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কেউ বিজেপিকে ইলেকটরাল বন্ডের মাধ্যমে বা অন্য কোনও ভাবে দান দিয়েছেন কিনা। মোদী এবং তাঁর প্রিয় ধনকুবেররা কি সেই সাহস দেখাবেন?