সব সৃজনশীল ব্যক্তিদের মতো রাধাপ্রসাদ গুপ্ত — যাঁকে সকলে RP বা শাঁটুলবাবু বা 'দা' সম্বোধন করত । তিনি নিজের সৃষ্টি বা রচনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, তাঁর লেখা গুছিয়ে রাখার কাজে সময় নষ্ট করতেন না ৷ আমরা কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি হঠাৎ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতেন, এবং তাঁর আরাম কেদারায় বসে চিন্তা করতেন। তারপর লাফিয়ে উঠতেন আর একগাদা কাগজ ফাইল ঘেঁটে অনেকক্ষণ পরে একটি হাতে লেখা বা টাইপ করা কাগজ বের করে বলতেন “এই দেখ। হতভাগাটাকে পেলুম। কোথায় কোথায় যে লুকিয়ে থাকে! আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি এটি অমুকের জন্যে লিখেছিলেন লিখেছিলাম।” আমরা ওই লেখা পড়তাম আর প্রয়োজন হলে তাঁর খাওয়ার টেবিলে বসে নিজের হাতে কপি করতাম। জেরক্স টেরক্স ছিল না।         

এই ব্যবস্থা আর অব্যবস্থার মাঝে,শুনেছিলাম সঞ্জিৎ চৌধুরী খুবই কষ্ট করে তাঁর লেখাগুলি বার করতে পেরেছেন, তা দেখে আমরা সবাই তাঁকে বাহবা জানাই, আর সঙ্গে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতাও ৷ এও শুনেছি জিৎ নাকি RP-র যত লেখা পেয়েছেন, তার এক কপি ওঁর ফাইলে বড় যত্ন করে রেখেছেন। ভাগ্যিস। আর হবেও না কেন? তিনি তো RP কাকাকে জন্ম থেকে দেখেছেন, বাবা বসন্ত চৌধুরীর বিশেষ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে। আমি তো দুই কিংবদন্তি পুরুষকে পেয়েছি অনেক পরে, কিন্তু তাঁরা দুজনেই আমায় কাছে টেনে নিয়েছিলেন ৷ কিন্তু জিৎকে প্রাণ থেকে অভিনন্দন না দিয়ে পারছি না ৷ তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ধন্যবাদ দিতে হবে মনিদি, RP-র অতি গুণী স্ত্রীকে, যিনি ওঁর অনেক লেখা যত্ন করে রাখতেন ৷ শুনেছি ওঁর ওই অমূল্য সম্পদ এক ভদ্রলোককে দিয়েছিলেন লেখাগুলিকে সম্পাদনা করে একটি বই বার করতে। তিনি তো করেনইনি, মনিদিকে ওই প্রবন্ধগুচ্ছও ফেরত দেননি। তা সত্ত্বেও শাঁটুলদার দুই মেয়ে বেশ কয়েকটা লেখা জোগাড় করে বর্তমান সম্পাদক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়কে দিয়েছেন। তবে এই খণ্ডের বেশির ভাগ লেখাই দেবাশিসের সংগ্রহ। তিনি আমাদের অতি সম্মানীয় গবেষক ও পণ্ডিত শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে প্রথম খণ্ডটি ছেপেছেন। তাঁকে এবং প্রকাশক অবনীন্দ্রনাথ বেরাকে এর জন্যে আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে।

শাঁটুলবাবুর অনেক লেখা আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি ভাবতাম বোধহয় ওঁর প্রায় সবকটা নিবন্ধই আমার জানা, কিন্তু বর্তমান সংকলনের লেখাগুলি দেখে বুঝলাম যে ওঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ আমি আগে দেখিনি। এই তালিকার মধ্যে থেকে ছোট বা হালকা লেখন বাদ দিলেও প্রচুর নিবন্ধ আছে যা আমি প্রথম বার দেখছি। তিনি যে কত বিভিন্ন বিষয়ে লিখতেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। এই সংকলন এবং এর আগেরটা দেখলে আমরা এখনও অবাক হই। সত্যি বলতে তিনি ছিলেন আমার দেখা প্রথম প্রকৃত বহুবিদ্যা বিশারদ, যাঁর কাছ থেকে কেউ মনমতো উত্তর না পেয়ে ফিরে যেতেই পারেন না। উল্টে যা জানতে এসেছিলেন তার চেয়ে বেশি জেনে ফিরেছেন। সত্যজিৎ রায়ের সেই সিধু জ্যাঠা।

রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুনেছি সত্যজিৎবাবু নাকি অনেক ব্যাপারে বা সমস্যায় তাঁর পরামর্শ নিতেন। অনেকেই মনে করেন RP-কে দেখেই তিনি ওই সিধু জ্যাঠা চরিত্রের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। আর এ সব ইন্টারনেট ও গুগল আসার অনেক আগের কথা। যদি জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোকে ধরা যায়, তাহলে শাঁটুল গুপ্ত এসবের গুগল ইত্যাদি সম্মানীয় পূর্বসূরি হিসেবেই কাজ করে গিয়েছেন। শুধু সত্যজিৎ রায় নয়, রাধাপ্রসাদ গুপ্তের বন্ধু মহলে ছিলেন অনেক সিনেমা বিশেষজ্ঞ। ছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও বংশীচন্দ্র গুপ্ত। এঁদের আর মুষ্টিমেয় কিছু ভালো সিনেমাপ্রেমীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪৭-এ প্রতিষ্ঠা করলেন বিখ্যাত ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। যদিও পরে তাঁর চর্চা আরো বহুধাবিভক্ত হয়, কিন্তু ‘বায়োস্কোপ’ নিয়ে (যা বলতে তিনি পছন্দ করতেন) বলতে গেলে তিনি অনর্গল হয়ে পড়তেন। এই বইটিতে দেখলাম তিনটি লেখা আছে এ বিষয়ে। আছে “বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপ”, “শতরঞ্জ কে খিলাড়ি” আর “শিল্পী আর মানুষ”। তিনটেই খুবই মূল্যবান।

লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ও ইতিহাস-বিশ্লেষক ইয়ান জ্যাকের ভাষায় “তিনি একাধারে অনেক- গ্রন্থানুরাগী, ইংরেজি ও বাংলায় লেখক, একজন রন্ধনবিশারদ, একজন চলচ্চিত্র বোদ্ধা, একজন চিত্র সংগ্রাহক। সর্বোপরি এ শহরের সংস্কৃতির ধারার তিনি একজন বক্তাও বটে, যাঁর আড্ডার ছলে উল্লাসের সঙ্গে বলে যাওয়া ঘটনা বা উপাখ্যানগুলি হত সূক্ষ্ম ও সুনির্বাচিত”। দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের এই বিবিধ লেখন একত্রীকরণ করার জন্যে আমরা সকলেই বাধিত। অতএব, ফিলিম ছাড়াও বহু সৃজনশীল মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল এবং তাঁদের ভাবের আর মন্তব্যের আদানপ্রদানও চলত । কমলকুমার মজুমদারের কথা অনেক শুনতাম, কিন্তু সামনা সামনি দেখিনি।

RP-র মাধ্যমে আমি খুবই কাছে পেয়েছিলাম মুল্করাজ আনন্দ, এবং রঘুবীর সিং প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে, যাঁদের সাহিত্য আর ফটোগ্রাফিতে বিশেষ প্রতিভা হিসেবে মানা হয়। মনে আছে মুল্করাজ আনন্দের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ে কতকিছু জানতে পারলাম। একইরকম সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন RP-র সুপ্রসিদ্ধ বন্ধু অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী, যিনি ছিলেন সূক্ষ্ম শিল্পদ্রব্যের একজন রসজ্ঞ পণ্ডিত। তারপর পরিচয় নিখিল সরকারের সঙ্গে, যিনি “শ্রীপান্থ” ছদ্মনামে লিখতেন। তিনি ছিলেন অধীনস্থ কলকাতা ও তার খেয়ালি সংস্কৃতির বিষয়ে একজন সুবিখ্যাত স্কলার। তিনি প্রায় প্রতিটি প্রাচীন জায়গা ও তার ইতিহাস জানতেন। শাঁটুলবাবুর সঙ্গে তাঁর অফুরন্ত আলোচনা শুনে আমি পুরাতন কলকাতার গল্পে ডুবে পড়লাম। RP’র সঙ্গে কথোপকথন শুধুমাত্র বিশেষ অভিজ্ঞতা নয়, তাঁর মেশার যে পরিধি, তা ছিল রোমাঞ্চকর। সবের মধ্যে পুরানো কলকাতা ছিল RP-র প্রাণ, তাঁর বিশেষ প্রেম ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। আমি তাঁর কাছে সেই ১৯৭৮ সালে ওই বিষয়টি বুঝতে গিয়েছিলাম, আর সেই থেকে এক আজীবন সম্পর্ক গড়ে উঠল। এই খণ্ডটিতে পুরাতন কলকাতার ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কয়েকটা প্রবন্ধ আছে। যেমন “ভারতে ইংরেজ: আমাদের চোখে”, “বাবু আর বিবি”, “কলকাতার স্থাপত্য”, “সাধের কলকাতা” ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি নিয়ে আমার চোখের সামনে কত আলোচনাই না হয়েছে, কত তর্কই না শুনেছি। কলকাতার স্থাপত্য নিয়ে পরে আমি বহু কাজ করেছি কিন্তু প্রথম বেলায় RP-র সেই অনুপ্রেরণা কখনও ভোলা যায় না।

শাঁটুলবাবুকে আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, অত বড় পদে চাকরি করে তিনি কলকাতার এতসব ওলিগলি ঘুরে দেখার সময় বার করলেন কী করে ? তাঁর জবাব ছিল যে মানুষ যাকে ভালোবাসে, তার জন্যে যেমন তেমন করে সময় ঠিকই বার করতে পারে। আমার মনে আছে তিনি একদিন হঠাৎ বললেন, আপিসের গাড়ি ছেড়ে ট্রামে চাপা যাক। আমি ছোটবেলায় ট্রাম আর বাস মিলিয়ে স্কুল-কলেজ গিয়েছি প্রায় ১৫ বছর, কিন্তু তারপর আর কোনও দিন উঠিনি ৷ অতএব তাঁর সঙ্গে ট্রামে বসে গল্প করতে করতে পথ চলাটা এক অভিনব অভিজ্ঞতা। কত এলাকার ইতিহাস জানতে পারলাম, আর তার সঙ্গে কত রাজকাহিনি ৷ এই সংকলনে ওঁর লেখা “তবু ট্রামের কোন ইতিহাস নেই” দেখে ভাল লাগল।

শিল্পকলা ছিল আরেকটি বিষয়, যেখানে তাঁর পাণ্ডিত্য অতি বিশাল ও গভীর। বিজ্ঞাপন দুনিয়ার লোকেদের শিল্পের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, কিন্তু শাঁটুলবাবু অনেক শিল্পীর থেকেও অনেক বেশি জানতেন। তিনি-ই আমায় উনিশ শতকের কলকাতায় কালীঘাট অঞ্চলে যে লোকশিল্প গড়ে উঠেছিল, তার সম্বন্ধে জানতে শিখিয়েছিলেন ৷ কলকাতাবাসীর কাছে এই ধাঁচ ছিল অভিনব আর এটি “কালীঘাটের পট” নামেই খ্যাত ছিল। পাশ্চাত্য জগতে তাঁদের পরিচয় করান উইলিয়াম এবং মিলদ্রাদ আর্চার ৷ আমি পুরনো বইয়ের দোকান থেকে তাঁদের কয়েকটি প্রকাশনা খুঁজে পাই ৷ পট থেকে আমার দৃষ্টি লোকশিল্পের আরো কয়েকটি ধারায় এবং প্রচলিত সৃজনশীলতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাঁর মুখে যামিনী রায়ের চিত্রশিল্পের বিভিন্ন কাল ও একেক পর্যায়ে তার বিবর্তন নিয়ে অনেক বার শুনেছি। এই বইয়ে দেখলাম তাঁর প্রবন্ধ “যামিনী রায়ের শিল্পের উৎস সন্ধানে”। এটি অতি প্রয়াজনীয়। RP-র সুবাদে আরেক মনে রাখার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন শুভ ঠাকুর- একজন শিল্পী ও ব্যঙ্গ-রচয়িতা। তাঁর চৌরঙ্গী আর এস. এন. ব্যানার্জি ক্রশিং স্থিত বাড়িতে ঠাসা ছিল পেন্টিং, ভাস্কর্য, টুকরোটাকরা প্রাচীন বস্তুতে আর ছিল তাঁর পাইপ, হুঁকো ইত্যাদি তামাক সংক্রান্ত বস্তুর অদ্ভুত সংগ্রহে। বসন্ত চৌধুরী, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত আর শুভ ঠাকুর যখন শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, আহা যদি এই তিনজনের ছবি তুলে রাখতে পারতাম ! এই বইয়ের “শিল্প” বিভাগের ছ'টি লেখাও খুবই আকর্ষণীয় ও তথ্যপূর্ণ।

রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ছিলেন এক খাদ্যরসিক মানুষ, নানারকম সুস্বাদু খাবার খেতে ভালোবাসতেন আর খাওয়াতেও। তাঁর গঠন ছিল অতি রোগা এবং পরিমাণে বেশি না খেলেও উৎকৃষ্ট খাবারের সন্ধানে থাকতেন। খবরের খুঁটিনাটি বুঝতেন। তার চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন খাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে। আর কত পড়াশুনাই না করেছেন! তাঁর “প্যারিস ও পটলডাঙ্গা” লেখা থেকে ওই আমলের প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত রেস্তোরাঁর কথা জানলাম। চাকরির সুবাদে আমি এত বার প্যারিস গিয়েও সেসব জানতে পারিনি। তাঁর “মাছ আর বাঙালি” পুস্তকটি সুপ্রসিদ্ধ। প্রচুর গবেষণার সঙ্গে রয়েছে তাঁর ওই বিখ্যাত রসিকতা। এই সংকলনে “খাদ্য সংস্কৃতি” বিভাগে আছে দশ-দশটি লেখা। এতেই বাজার মাত করা যায়।
সবশেষে এই শাঁটুলবাবুর এই সংকলনটি প্রকাশ করার জন্য এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই ৷

No comments on 'রাধাপ্রসাদ গুপ্ত: প্রবন্ধ সংগ্রহ ২ এর মুখবন্ধ । বাণীশিল্প প্রকাশনী'

Leave your comment

In reply to Some User