প্রেসিডেন্সি কলেজের মুশকিল হয়েছিল এই যে, দেড়শো বছরেরও বেশি আগে, বাংলার নবজাগরণের সময়েই এটি নিছক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলার বৌদ্ধিক উৎকর্ষের প্রতীক। তখন থেকেই সেই ভাবমূর্তির দায় তাকে বহন করতে হয়েছে। অর্ধ শতাব্দী আগে— আমাদের তখন ছাত্রাবস্থা— নকশাল আন্দোলন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাটিকে বিপর্যস্ত করার পরে কয়েক দশক ধরেই এই প্রতিষ্ঠানের মান পড়ে যাওয়া নিয়ে অনেকে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছেন। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই যে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন, তা থেকে মনে হয় এই উদ্বেগের কিছুটা বাড়াবাড়ি ছিল। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের ‘এলিট-বিরোধী’ শিক্ষানীতি এই কলেজের খুব ক্ষতি করেছে, সেটা অনস্বীকার্য। যদিও এই সময়ে অন্য নানা কলেজ বেশ কিছুটা উন্নতি করেছিল। সেটা এক দিক দিয়ে ভাল, কারণ একচেটিয়া আধিপত্য খারাপ জিনিস। কোনও একটা কলেজ আধিপত্য করবে বা বেশি সুবিধা পাবে— এই ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে ক্ষতি করেছে, তা হল প্রায় তিরিশ বছর ধরে কিছু শিক্ষক সংগঠনের একাধিপত্য। এই সংগঠনগুলি এমন বেশ কিছু ভাল শিক্ষককে রীতিমতো হেনস্থা করে তাঁদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল, যাঁরা তাদের মতে মত দেননি। এবং একটি সরকারি কলেজ থেকে আর একটিতে বদলি করার নীতির (সার্কুলেটরি ট্রান্সফার পলিসি) সুযোগ নিয়ে কোচবিহার বা ঝাড়গ্রামের মতো বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পাঠানো হয়েছিল। আবার এই সংগঠনগুলিই এমন অনেক শিক্ষককে নিয়োগ করেছে যাঁরা তেমন যোগ্য নন। কিন্তু এ-ও দেখেছি, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা কলেজ-প্রাক্তনী প্রেসিডেন্সির মান উন্নয়নের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। ২০১০ সালে তিনি দলের কট্টরপন্থীদের বুঝিয়েসুঝিয়ে প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর দশ মাস পর ক্ষমতায় এসেছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও কয়েক পা এগিয়ে যান। ক্ষমতায় এসেই এক মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য ইতিহাসবিদ সুগত বসুর নেতৃত্বে তিনি একটি মেন্টর গ্রুপ তৈরি করেন। এবং প্রেসিডেন্সিকে সব রকমের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। এই গ্রুপে বেশ কয়েক জন খ্যাতনামা পণ্ডিত ছিলেন। স্বয়ং অমর্ত্য সেন এই উদ্যোগকে সমর্থন করেন।
কিন্তু এত সহযোগিতা এবং গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কেন এমন ভাবে ব্যর্থ? বিশেষত গত কয়েক বছরে? এ কথা ভাবতে সত্যিই খুব কষ্ট হয় যে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক প্রকাশিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র্যাঙ্কিং-এ দেশের প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রেসিডেন্সির নাম নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় ষষ্ঠ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্দশ স্থান পেয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্সির স্থান কল্যাণী এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক পরে। বহু অনামা বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন ভদ্দেশ্বরম-এর কোনেরু লক্ষমাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়, করাইকুডি-র অলগাপ্পা বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকী মিজোরাম বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রেসিডেন্সির আগে। প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এটি নতুন, তাই পিছিয়ে থাকাটা চিন্তার ব্যাপার নয়। কিন্তু এই যুক্তি মোটেই ধোপে টেকে না। দু’বছর আগে, যখন প্রেসিডেন্সি আরও নতুন ছিল, তখন কিন্তু সে এই তালিকায় প্রথম পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্যবাহী কলেজ-বাড়ির সংস্কার করে পাঁচতারা হোটেলের রূপ দিতে সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করতেই ব্যস্ত— যে সব সংস্কারের অনেকটারই কোনও প্রয়োজন ছিল না— আর তাই পড়াশোনা ও গবেষণার দিকে মন দিতে পারেননি, সময়ও ছিল না। প্রেসিডেন্সি প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই— এতে প্রায় সবাই লজ্জিত, কেবল উপাচার্যের কোনও হেলদোল নেই, তিনি প্রেসিডেন্সিকে সাজিয়েগুছিয়ে তাঁর রুচিপছন্দ জাহির করতে ব্যস্ত।
গত তিন বছরে শিক্ষার মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, দুই-ই পড়েছে। তার একটা বড় কারণ, বহু প্রসিদ্ধ অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছেন। যেমন, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, সোমক রায়চৌধুরী, এবং আরও অনেকে। উপাচার্যের কাজের ধরনের সঙ্গে এঁরা কেউই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। অন্যরা, যাঁদের মেন্টর গ্রুপ প্রেসিডেন্সিতে আসতে অনুরোধ করেছিল, এবং যাঁরা সত্যিই ভাবছিলেন এখানে ফিরে আসবেন কি না, তাঁরাও না-আসাই সাব্যস্ত করেন। বহু বিশেষ সম্মানিত অধ্যাপক-এর পদ তৈরি করা হয়েছে, যাতে কৃতী অধ্যাপকরা এসে পড়ান। কিন্তু স্থানীয় এক জন ছাড়া কেউই যোগ দেননি বা যোগ দিলেও থেকে যাননি। তারও কারণ একটা শ্বাসরোধকর আবহাওয়া। সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কী করে চলতে হয়, শিক্ষকরা সচরাচর সেটা ভাল জানেন। চার বছর অনেক সময়— বর্তমান উপাচার্য প্রধানত কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করেছেন বটে, কিন্তু চার বছরে এই পারস্পরিক সহযোগিতার বিদ্যেটা শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া তাঁর উচিত ছিল। তেমন কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি। এখন তিনি প্রেসিডেন্সি নিয়ে বিপুল খরচে তৈরি সুদৃশ্য, চকচকে একটি কফি-টেবল বই বিতরণে ব্যস্ত। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার সময় কর্পোরেট সংস্থারা ব্যাঙ্কের মন ভোলানোর জন্য এ ধরনের বই তৈরি করে। এই বইয়ে বাংলার অনেক বিশিষ্ট মানুষের লেখা রয়েছে, যাঁরা অতীতে প্রেসিডেন্সির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এটা করুণ পরিহাসের ব্যাপার যে, তাঁদের অনেকের লেখাতেই বিভিন্ন বিভাগের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে রীতিমতো বিষাদের সুর। অনেক বিভাগেই কোনও প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরও নেই। তরুণ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসররা মুষ্টিমেয় প্রবীণ শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে বিভাগগুলি যথাসাধ্য দক্ষতায় পরিচালনা করছেন। প্রেসিডেন্সির পরিচালকদের স্বরচিত সমস্যাগুলি ন্যাশনাল গ্রেডিং বডি ন্যাক-এর তালিকায় প্রেসিডেন্সিকে নীচের দিকে নামিয়ে দিচ্ছে। বরং আগে যখন প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল, তখন— সরকারের কাছে এখনকার চেয়ে অনেক কম সাহায্য পেয়ে— ন্যাক-এর তালিকায় অনেক উপরে স্থান পেয়েছিল। সিনিয়র পদগুলি কেন ভর্তি করা যাচ্ছে না, ন্যাক এবং এনআইএফআর সেটা বুঝতেই পারছে না। আমরা অবশ্য রহস্যটা জানি।
শিক্ষকের এই অভাব কেন, সেটা ছাত্রদেরও বোধগম্য হচ্ছে না, কিন্তু এর পরিণামেই এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলি বিভাগে বহু আসন খালি থেকে গিয়েছে। পরিচালকদের ব্যর্থতাই এর একটা বড় কারণ, এবং রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকেও এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য জোরদার আবেদন জানাতে হয়েছে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সর্বত্র সেরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভাল ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণ করতে পারে বলেই তারা বছরের পর বছর দুর্দান্ত ফল করে। হাজার সমস্যার মধ্যেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ছেলেমেয়েরা একত্র হয়, তর্ক করে, একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, তাদের দুরন্ত প্রাণশক্তিতে কলেজের ক্লাসরুম, করিডর গমগম করে, সেটাই একটা উৎকৃষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে রাখে। সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা হল, এই গোত্রের ছেলেমেয়েরা এখন খুব কম সংখ্যায় প্রেসিডেন্সিতে পড়তে আসে। যারা আসে, তারাও চার দিকে দেখে একটা দম-চাপা পরিস্থিতি— চুক্তিতে নিযুক্ত নিরাপত্তাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা ও কর্ত্রীদের সেলাম ঠুকতে ব্যস্ত, এবং ব্যস্ত সকলের উপর নজর রাখতে। এ রকম একটা পরিস্থিতি আগে কখনও ভাবাই যেত না।