২০২৩ সালে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকার নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন -'আনন্দ শতক'-এ অন্তর্ভুক্ত
কলকাতা মহানগরীর সঠিক এবং প্রাণবন্ত কেন্দ্রবিন্দু বলতে আমরা সাধারণত ধর্মতলা ও চৌরঙ্গীর সংযোগস্থলকেই মনে করি। দীর্ঘ উত্তর -দক্ষিণ সড়ক কে অনেক নামে চিনি — চিৎপুর, বেন্টিঙ্ক, চৌরঙ্গী বা জওহর লাল নেহেরু রোড, আশুতোষ মুখার্জি ও শ্যামাপ্রসাদের নামের রাস্তা, তারপর দেশপ্রাণ শাসমল রোড। আবার পশ্চিমে গঙ্গার দিক থেকে পূর্বে যাওয়া রাজপথকে আমরা বরাবরই ধর্মতলা বলেই ডেকেছি, যদিও পুরপিতারা অনেক দিন আগেই এর নাম বদলেছেন লেনিনের সম্মানে। দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে আমরা কিন্তু একবারও প্রশ্ন করিনা আড়াইশ বছর পুরানো এই দুই প্রধান সড়ক কাদের ইতিহাস বহন করে চলেছে। ধর্মতলা কোন ধর্মের নামে? আর ওই চৌরঙ্গীর মানে কি?
অল্পে বলতে গেলে- ধর্মতলা রাঢ় বাংলার সেই বিখ্যাত লোকদেবতা ধর্মঠাকুরের নামে। তাঁকে নিয়ে মধ্য যুগে কত ধর্মমঙ্গলই না লেখা হয়েছে। পশ্চিমী জেলাগুলিতে লাউ সেন বনাম ইছাই ঘোষের লড়াইয়ের গল্প এখনও তাজা ইতিহাস। ধর্মতলার ধর্মঠাকুরের মন্দির এখনও আছে, লোটাস সিনেমার সামনে। সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল অনেকদিন আগে, রাস্তা চওড়া করার সময়। এই প্রাক্ হিন্দু দেবতাকে সঙ্গ দিচ্ছেন আর একটি subaltern ধর্ম, নাথ সম্প্রদায়ের গুরু, চৌরঙ্গী বাবা। কালীঘাট গামী তীর্থযাত্রীরা তাঁর ডেরায় আশ্রয় পেতেন আর এটি অবস্থিত ছিল আজকের ঝলমলে রাস্তার সংলগ্নে।
এক কথায়-উচ্চবর্ণীয়, উচ্চবর্গীয় ভদ্রলোকেদের সাম্রাজ্যের ভিত কিন্তু প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ভরসা করে মধ্য ও নিম্ন বর্গীয় সম্প্রদায়ের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর। বাংলায় দেশজ বা আদি বাসিন্দারা সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্তেও যুগ যুগান্ত ধরে তাঁদের উপর শাসন চালিয়ে গেছেন উচ্চ জাতির সংখ্যালঘু হিন্দুরা — এমনকি বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলেও। আর তারপর তাঁদের দমন করে রেখেছিলেন পাঠান ফার্সি ও অন্যান্য আশরাফ মুসলিম গোষ্ঠীরা।প্রজা তো প্রজা-ই, সে হিন্দু হোক বা মুসলমান। বাংলায় হাজার বছর পুরানো বৃহৎ মন্দির স্থাপত্যের অভাব থেকে অনুমান করা যায় যে সাধারণ মানুষ তথাকথিত হিন্দু যুগেও উচ্চ শ্রেণীর ধর্মের প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট হন নি। ওই যুগেও বাঙলার হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজারা এখানে কোন মাদুরাই-থাঞ্জাভুর-মহাবালেশ্বর, কোনার্ক-ভূবনেশ্বর বা ইলোরার মত মহত্তম ও বৃহৎ মন্দির স্থাপত্যের নির্মাণ করতে পারেননি বা করেননি। এসব প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন সমৃদ্ধ রাজা, অজস্র রাজস্ব, মজবুত ব্রাহ্মণ শ্রেণী এবং প্রজাদের অঢেল সমর্থন। এই সব না থাকায়, প্রাক ইসলামীয় যুগের মন্দির তো পূর্ব ও উত্তর বঙ্গে পাওয়াই যায় না, আর রাঢ় অঞ্চলে তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। বাঁকুড়ায় দুটি, বর্ধমানে দুটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় একটি আর বরাকর-পুরুলিয়া প্রান্তে ছিল গুটিকয়েক। কিন্তু একই দেশে পাহাড়পুরে, মহাস্থানগড়ে, সোমপুরায়, বিক্রমপুরে, চিরুটিতে আমরা বিশাল বৌদ্ধ স্থাপত্যকর্ম পাই।
আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ইতিহাসের আদি ও মধ্য যুগে বাংলায় (রবার্ট রেডফিল্ডের ভাষায়) লিটিল ট্র্যাডিশন অর্থাৎ গৌণ বা লোক ধর্মীয় পরম্পরাই প্রভাবশালী ছিল। ওই আচার-বিশ্বাস পদ্ধতি গ্রেট ট্র্যাডিশন (মহান বা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম) বা মন্দির- ভিত্তিক সভ্যতার চেয়ে অনেক বেশি প্রকট বা বিস্তারিত ছিল।এখানে আদি ও মধ্য যুগে গ্রেট ট্র্যাডিশন বা পৌরাণিক দেবদেবীর বিশাল আকারে পূজার নিদর্শন পাওয়াই যায়না।আজকাল যা মন্দির আমরা দেখতে পাই সবই ষোড়শ শতাব্দীর পর, সবচেয়ে বেশি হলে মাত্র শ’দু’শ বছর পুরোনো। সত্যি বলতে সাধারণ মানুষ মঙ্গল কাব্যের পালা শুনতে ও দেখতে ভিড় করত যেখানে মনসা, শীতলা, চন্ডীর মতন লৌকিক দেবীরা পৌরাণিক দেবদেবীদের জব্দ করত। তা দেখার জন্যে বাংলার সাধারণ নাগরিক রাতের পর রাত জাগত। এই তথাকথিত নিম্ন বর্গের জনসমুদ্রকে নিজের দিকে টানার জন্যেই উচ্চ বর্ণের গরিব গ্রাম্য কবিরা লিখেছিলেন অগণিত মঙ্গল কাব্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য আর শ্রী নিত্যানন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ওই একই লক্ষ্য ছিল — নিম্ন ও মধ্য জাতির বৃহৎ জনসংখ্যাকে নিজেদের দিকে টানার যারা ক্রমাগত ইসলামের দিকে ঝুঁকছিল ।
অন্য দিকে অসংখ্য সুফি আর পীরেরা তো জাতি -বিভাজিত সমাজে গৌণ সম্প্রদায়ের মানুষের মন জয় করছিল। এরা বাংলার বৃহৎ সংখ্যার মানুষের জন্যে ইসলাম ধর্মকে অনেক সহজ আর মানানসই করেছিল। এখনকার হিসাবে ২৬ কোটি বাঙালির মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়ংশ ইসলাম বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। কিন্তু শত করা বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা ও সত্তা-ই প্রধান এবং গর্বের কারণ।
পাশাপাশি বাংলায় নিম্নবর্গের লোকেদের দেবদেবীদের স্থান করে দিয়েছিল মঙ্গলকাব্য। আর গৌর নিতাই সব জাতিকে বুকে টেনেছিল। এই সামাজিক ও ধর্মের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বঙ্গীয় সংস্কৃতির বৃহৎ ছত্রছায়ায় বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিজেদের স্থান করে নিলেন। ভাষা তাদের মধ্যে এক অটুট বন্ধন আর খাদ্য রুচি প্রায় এক। বিশ্বের মানুষ অবাক হয়ে দেখে সব ধর্ম ও শ্রেণী নির্বেশেষে বাঙালি কি ভাবে মাছ খায় আর কথা বলতে বলতে মুখ থেকে এক গাদা কাঁটা বার করতে পারে। বিশ্বে আর কোন জাতি পারে বলে জানা নেই।
বাঙালির জীবনে লোক বিশ্বাস এখনও প্রচন্ড প্রভাবশালী। তার মানে এই না যে তাঁরা ইসলাম বা হিন্দু ধর্মকে কোন অংশে অবজ্ঞা করছে। ওঁরা মনে করেন কেউ যদি সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের উৎসব করে সুস্বাদু সিন্নি দেয়, খাবো না কেন ? কেউ যদি ওলাই চণ্ডীকে ওলাই বিবি বলে মাথা ঠেকায় - করুক না। অনেক পীরের দরগায় তো হিন্দুরাই বেশী ভিড় করে আর ধূপ গোঁজা তো মন্দিরের বাইরেও হয়। হরি নাম সংকীর্তনের পর বাতাস বা হরির লুট কি নবি গুন পাঠের পর বাতাস বিতরণ করা দেখে এল, না কি তার উল্টোটা সত্যি? তা আমরা বলতে পারব না কিন্তু তর্ক না করে আরও দুটি বাতাসা খাওয়াই ভাল। দক্ষিণ রায় আর বনবিবি কোন ধর্মের জেনে লাভ কি — বাঘের হাত থেকে রক্ষা করলেই হল।
এই মনোভাব অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন নি — মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও না আয়ুব খান তো নয়ই। দুজনেই জোর করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কে দমন করার প্রচুর চেষ্টা করেছিলেন আর কিছুতেই মানতে পারেন নি সাচ্চা মুসলমান কি করে এই ভাবে তাঁদের ফরমানের বিরোধিতা করছে। পশ্চিমবঙ্গে ভদ্রলোকদের একটি শ্রেণী লাগাতার প্রচার করেছে এবং করে চলেছে “আমরা বাঙালি ওরা মুসলমান”। মানেটা স্পষ্ট না হলেও দম্ভ আর বিদ্বেষ খুবই পরিষ্কার। কিন্তু পশ্চিমের হিন্দুদের মাঝে এই বিভ্রান্তিকর প্রচারের উচিত জবাব দিয়েছেন বাংলার নির্বাচকেরা, মাত্র কয়েক মাস আগে।
যাঁরা এই সব উক্তি করেন তাঁরা জানেন না যে বাঙালি জাতিকে ইতিহাসে প্রথমবার একত্রিত করেছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পৃথক অঞ্চল বা রাজ্যগুলিকে এক করে নামকরণ করেছিলেন স্বাধীন ও সংযুক্ত বাংলা সুলতানাত। তখনকার অভিজাত ব্রাহ্মণ তাঁদের দেবভাস ছেড়ে বাংলায় কথা বলতে রাজি ছিলেন না, বাংলায় লিখতেন তো না- ই। বাংলা ভাষায় আনুমানিক দশ হাজারেরও বেশী ফার্সি ও আরবি শব্দ আছে কিন্তু ক্রমশ অনেক বেশি শব্দ আমদানি করা হল সংস্কৃত থেকে। অলংকার ও উপযোগিতা তো বাড়ল কিন্তু বেশ কয়েকটি ফার্সি বা আরবি শব্দকে চেপে দেওয়া হল, অন্তত কলকাতার ভদ্রলোক সমাজে। ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নিজের স্বার্থে স্থাপন করেছিল তা হয়ে উঠল সংস্কৃত পন্ডিতদের ঘাঁটি। ওখানকার পণ্ডিতরা অঢেল সংস্কৃত শব্দ তৎসম বলে প্রয়োগ করে অনেক নতুনত্ব আনলেন ঠিকই কিন্তু তার সাথে বাংলা ভাষার হিন্দুকরণও বাড়ল। একই সময়, বিদেশি শাসকদের Permanent Settlement বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে হিন্দু এক নতুন জমিদার শ্রেণী তৈরী হল আর পুরোনোদের এক গোষ্ঠীকে আরো শক্তিশালী করতে সাহায্য করল। পাশাপাশি এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাচ্যবিদ্যাবাদীরা সম্পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি না করেই ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের একতরফা ব্যাখ্যা মেনে নিলেন। তাঁরা প্রচার করলেন যে হিন্দু সমাজ আদি কাল থেকেই উচ্চবর্ণ কেন্দ্রিক ছিল। ইতিহাস দিয়ে এটি প্রমান করা মুশকিল কিন্তু ‘মিথ’ টি শুধু প্রতিষ্ঠিতই হল না তা এক অনড় সত্যে পরিণত হল।
বাংলার অর্থনীতি ও সমাজে আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে ভাষা ও সংস্কৃতিকেও হিন্দু ভদ্রলোক গোষ্ঠী প্রায় পুরোপুরি অপহরণ করল। তা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম আর অন্য হিন্দু শ্রেণীর মানুষ কিন্তু আস্থা হারায় নি। বাংলার নবজাগরণেও খুব একটা স্থান না পেলেও সব বাঙালি-ই রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্ব করে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাঙালিদের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের আনন্দ ও জয়ে সব স্তরের বাঙালিই অংশ গ্রহণ করেন। আর এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার ফলে বাঙালি জাতির মাঝে গড়ে উঠল এক পৃথক সমন্বয়মুখী চরিত্র ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। যার জন্যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিল পূর্বে-এখনকার বাংলাদেশে।
ধর্মভেদ বা জাতিভেদ পুরো ভাঙা এখনও সম্ভব হয়নি কিন্তু পশ্চিম বা পূর্ব বঙ্গদেশে তার জন্যে জ্যান্ত জ্বালানো হয় না কাউকে। সহপাঠীদের বা সহকর্মীদের জাত কেউ পোছে না। বেশির ভাগ বাঙালির মধ্যে আছে এক আশ্চর্য ঔদার্য যা এই মহাদেশের অন্য প্রান্তে পাওয়া বিরল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে বাংলার মানুষের এই অন্তর্নিহিত সমন্বয়গামী সংস্কৃতির গভীরতা আর শক্তির পরীক্ষা বাড়ছে। দু বাংলাতেই মৌলবাদীরা শুধু মাথাচাড়াই দিচ্ছেনা ক্ষমতা দখল করার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে।
নিকট ভবিষ্যতেই আমাদের আবার প্রমান করতে হতে পারে যে এই বিশাল উপমহাদেশের এত ভাষাগত জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বাংলা তার ঐতিহ্যে অটল। কিন্তু কোনো মনীষী তো আর চোখে পড়ছে না। কোথায় গেলেন আমাদের রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, নজরুল,মুজিবুর অথবা শ্রী অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন ? সত্যজিত রায়ের কোন উত্তরাধিকারী নেই আর গত দু বছরে আমরা হারালাম দুই বাংলার প্রকৃত বিবেক — আনিসুজ্জামান ও শঙ্খ ঘোষ। অমর্ত্য সেন আর কত দিন টানতে সক্ষম হবেন? তারপর ? এই মাপের তো আর কাউকেই দেখতে পারছি না। তাহলে কে দেখাবে পথ ? কে বা কারা আমাদের পাশে থেকে বোঝাবে বাঙালিদের এই গভীর ভাষাপ্রেম, সহনশীলতা, ধর্মনিরেপেক্ষতা, সমন্বয়মুখী সংস্কৃতি কিন্তু আমাদের উপর একটি বিশেষ দায়িত্বও দিয়েছে? তা হল আমাদের অনুপম বাঙালি সত্তা আর উদার বিশ্বাস কে আঁকড়ে ধরে থাকা আর ধার্মিক ও সামাজিক বিদ্বেষের প্রতি চালিয়ে যাওয়া আমাদের অক্লান্ত আপসহীন বিরোধ।