বিশ্বের নানা দেশের বিভিন্ন মহানগরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাই যখন কলকাতায় আসি, তখনই আমার মনে হয়, এখানে এমন সম্ভাবনা আছে, যা আমরা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারি।
বিশ্বের অনেক জায়গাতেই নাগরিক জীবনের কেন্দ্রে থাকে নদী। যেমন, প্যারিসের শোন্, লন্ডনের টেমস, কায়রোর নীলনদ বা ব্যাংককের ছাও ফ্রায়া। দিনে হোক বা রাতে, রিভার ত্রুজ -এ যাওয়া সে সব শহরের বাসিন্দাদের জন্য একটা 'আবশ্যিক কর্তব্য'। কিন্তু জলের চেয়ে জমির দিকেই বাঙালিদের টান বেশি। কলকাতার লোক বড়জোর নদীর ধারে আসে একটু টাটকা হাওয়া খেতে। নদীতে আমরা দেখি শুধু দেশি নৌকো বা বড়ো বড়ো মালবোঝাই নৌকো। যেগুলো দেখতে রীতিমতো বিশ্রী। বজবজ থেকে বারাকপুর পর্যন্ত নদী বেয়ে গিয়েছি। তখন দেখেছি প্রিন্সেপ ঘাট থেকে কাশীপুর ঘাট পর্যন্ত নদীর ধারে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে রাতে প্যারিসের মতো 'ফ্লাডলাইট ট্যুরিজম'-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিছু কিছু জায়গার চেহারা অবশ্য কুৎসিত। সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে।
কলকাতার ট্রাম, বিশেষ করে ময়দান ও সংলগ্ন এলাকায়, একটা বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে। সহজেই আমরা কয়েকটি রংচঙে ট্রাম শুধুমাত্র স্থানীয় এবং বিদেশী পর্যটকদের জন্য রেখে দিতে পারি। চিৎপুর রোডের কথাই ধরা যাক। রাস্তাটার আনাচে - কানাচে ইতিহাসের গন্ধ। কিন্তু গাড়িঘোড়ার ভিড় ঠেলে যাওয়াটা বিরাট সমস্যা। ধীরগতির ট্রামে বসে চিৎপুর রোড ধরে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হতে পারে।
কলকাতায় আমি অনেক সময়েই গ্রিল ঘেরা বারান্দার ছবি তুলেছি। নিউ ইয়র্কের ট্ৰেবেকায় একটা হেরিটেজ ওয়াক আছে, শুধুমাত্র গ্রিলের নকশায় ফুটে ওঠা নাগরিক শৈলী দেখার জন্য। তা হলে কলকাতায় নয় কেন?
ময়দানটাকেও লন্ডনের কেনসিংটন গার্ডেন্সের মতো সাজিয়ে তোলা যায়। বিভিন্ন গাছ, বাহারি শেড, জলাশয়, পায়ে চলা পথ, ফোয়ারার মতো নানা আকর্ষণের ব্যবস্থা করে আমরা শহরের মাঝখানে একটা 'ফুসফুস' তৈরি করে দিতে পারি। তা হলেই রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য হবে তাদের সভা করার জন্য রাজারহাট বা শহরের উপকন্ঠে অন্য কোনো জায়গা খুঁজে নিতে। যানজটের হাত থেকে বাঁচবে শহর।
বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষের সময় পার্ক স্ট্রিট এলাকাটা যেন একটা 'ওয়ান্ডারল্যান্ড' হয়ে ওঠে। আমরা কি এ রকম অন্য কোনো রাস্তায় সারা বছর ধরে চন্দননগরের আলোকসজ্জা রেখে দিতে পারি না? কিছু কিছু এলাকায় আলোর স্থায়ী 'থিম ওয়াল' তৈরি করা যায়। তার সঙ্গে খোলা আকাশের নিচেই মিলতে পারে একটু অন্য স্বাদের বিনোদনের নানা ব্যবস্থা।
স্ট্র্যান্ড রোডের ধরে থাকা গুদামগুলোকে আমরা বিশ্রী পোড়া বাড়ি হিসেবেও দেখতে পারি, আবার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে সেগুলোই ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। সারা পৃথিবী জুড়ে বড়ো বড়ো গুদামগুলোকে আর্ট গ্যালারি বা মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছে।
নিউ মার্কেটকে সম্পূর্ণ ট্রাফিকমুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা উচিত। আমার তো মনে হয়, ওই এলাকাটা পায়ে হেঁটে ঘুরতে দারুণ লাগবে লোকের। এ ভাবে পর্যটনের সঙ্গে ইতিহাস আর বাণিজ্য, দুটোকেই মেলানো যাবে।
কলকাতায় 'স্ট্রিট আর্ট' খুব কম। বিদেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় দেখেছি মূৰ্তি, ভাস্কর্য, ম্যুরাল। পুরোনো দেওয়ালে গ্রাফিতির ছড়াছড়ি। আমাদের শহরে এতজন শিল্পী রয়েছেন। দরকার শুধু একটা উদ্যোগ এবং কিছু অর্থের যোগান। এটুকু হলেই নানা ধরণের শিল্পের ছোঁয়ায় কলকাতার রাস্তাঘাটে জীবন্ত হয়ে উঠবে।
এই শহরেই তো দুর্গাপুজোর সময়ে নাগরিক লোকশিল্পের চরম উৎকর্ষ দেখা যায়। তা হলে সারা বছর নয় কেন? আসলে আমাদের সম্ভাবনা অনেক। সেটা কাজে পরিণত করতে দরকার শুধু আগুনের একটা ফুলকি। তা হলেই সারা বছর নানা বিস্ময়ে সেজে উঠবে আমাদের শহর।
