গুটিবসন্ত নামক ভয়াবহ ব্যাধিটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই সম্ভবত শীতলার সৃষ্টি, এবং এই ধারণা প্রচার করা হয়েছে যে, তাঁকে ভাল করে পুজো করে সন্তুষ্ট করতে পারলে এই রোগ থেকে তিনি মানুষকে বাঁচাবেন।
যাঁ রা মনে করেন, শীতলা নিতান্তই গ্রামের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের আরাধ্য রকমারি স্থানীয় দেবদেবীর এক জন, তাঁদের জানা নেই, তিনি গোটা ভারতে পূজিত হন। কেবল দক্ষিণ ভারতের কিছু এলাকায় তাঁর পুজো হয় না, কারণ সেখানে সর্বার্থসাধিকা দেবী মারিয়াম্মার রাজত্ব। স্কন্দপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মতো কয়েকটি প্রাচীন পুরাণে শীতলার কথা আছে, সেখানে তাঁকে গুটিবসন্তের (স্মল পক্স) নিয়ন্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে। যজ্ঞের আগুন থেকে তাঁর উদ্ভব, এবং ভগবান ব্রহ্মা কেবল তাঁকে নয়, তাঁর সহচর জ্বরাসুরকেও পুজো করার জন্য মানবজাতিকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
আবার অন্য কাহিনিতে দেখি, দুর্গা কাত্যায়ন মুনির ছোট্ট মেয়ে হয়ে জন্ম নেন এবং তাঁর শৈশবের বন্ধুদের কলেরা, উদরাময়, হাম, গুটিবসন্ত ইত্যাদি নানান ব্যাধি থেকে রক্ষা করেন। এই কাত্যায়নীর আর এক রূপ হল শীতলা। ব্রহ্মার কন্যা এবং কার্ত্তিকেয়ের স্ত্রী হিসেবেও শীতলাকে দেখা যায়। পুরাণ ছাড়াও এই দেবী আছেন সহজ সরল লোককথায়, যেমন শীতলা কথা, মঙ্গলকাব্য। আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় কবি মানিকরাম গাঙ্গুলি, দ্বিজ হরিদেব বা কবি জগন্নাথ, এমনকী আরও এক শতাব্দী আগে কবি বল্লভ এবং কৃষ্ণরাম দাস শীতলার বন্দনা করেছেন।
১৯৭৯ সালে, আশা করা যায়, পৃথিবীতে এই রোগের জীবাণু নির্মূল করা গেছে, দেবীর আশীর্বাদে নয়, প্রতিষেধকের জোরে। তার আগে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গুটিবসন্ত ছিল এক কালান্তক রোগ, আনুমানিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ তার বলি হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের আশি শতাংশই মারা যেত, বড়দের মধ্যেও যাঁরা প্রাণে বাঁচতেন তাঁদেরও দেহে এই ব্যাধি ভয়াবহ দাগ রেখে যেত, অনেকেই দৃষ্টিশক্তি হারাতেন। এ রোগের জীবাণু হাওয়ায় ভেসে সংক্রমণ ঘটাত, ফলে খুব সাবধান হয়েও রেহাই মিলত না। এমন রোগের মোকাবিলায় ধর্মের তো কিছু একটা করতেই হত। যে ভাবে শীতলা দেবী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন সেটা দেখিয়ে দেয়, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কতটা নমনীয় ছিল, বিচিত্রতম লোকাচারকেও সে কী ভাবে আত্মসাৎ করে নিত। নানান পুরাণে কত অসুরকে বধ করা হল, কিন্তু জ্বরাসুর পুজো পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন কেবল এই কথা বলে যে শিবের উষ্ণ স্বেদ থেকে তাঁর জন্ম! এমনকী বৌদ্ধধর্মেও জ্বরাসুর এবং শীতলাকে মেনে নেওয়া হল, তবে রোগব্যাধির প্রধান দেবী পর্ণ-শর্বরীর সঙ্গী হিসেবে। সেখানে আবার এ-ও দেখি যে, ব্যাধি-হন্তারক বজ্রযোগিনীর রোষ থেকে বাঁচতে এই দুই দেবী পালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারতবাসীরা কী ভাবে শীতলা পুজো করে গুটিবসন্তের বিভীষিকা থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করত, ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরা তা বিভিন্ন সময়ে দেখিয়েছেন। তিন শতাব্দী আগে কলকাতার ‘ব্ল্যাক হোল’ খ্যাত জে জেড হলওয়েল এই দেবীর আরাধনা বিষয়ে লিখেছেন। দুই শতাব্দী আগে জন মুর তাঁর হিস্ট্রি অব স্মলপক্স বইতে শীতলার কথা উল্লেখ করেছেন। এক শতাব্দী আগে সি এইচ বাক লিখছেন, ‘শীতলা বা মাতা হলেন সাত বোনের এক গোষ্ঠীর নেত্রী, এই সাত দেবীই মহামারী ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁকে নিয়মিত তুষ্ট করা নারী ও শিশুদের দায়িত্ব।’ আধুনিক ওযুধপত্রের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শীতলা ও তাঁর বোনদের প্রতিপত্তি কমেছে ঠিকই, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, গোড়ায় তিনি ছিলেন এক অশুভ শক্তি। মার্কিন নৃবিজ্ঞানী র্যাল্ফ নিকোলাস গত শতকের সত্তরের দশকে মেদিনীপুরে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে স্থানীয় ধর্মাচারকে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং এ বিষয়ে বেশ কিছু মূল্যবান লেখা লিখেছেন।
গুটিবসন্ত নামক ভয়াবহ ব্যাধিটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই সম্ভবত শীতলার সৃষ্টি, এবং এই ধারণা প্রচার করা হয়েছে যে, তাঁকে ভাল করে পুজো করে সন্তুষ্ট করতে পারলে এই রোগ থেকে তিনি মানুষকে বাঁচাবেন। হিন্দুদের পুজোয় বড় কোনও দেবতার ‘আরাধনা’ আর শনি বা শীতলার মতো ছোটখাটো স্থানীয় দেবদেবীকে ‘খুশি করা’র মধ্যে মৌলিক কোনও তফাত করা হয় না, এ বিষয়ে নানা সংগঠিত ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের একটা পার্থক্য আছে। শীতলার ক্ষমতা নিয়ে অনেক গল্প আছে। শিবের পরম ভক্ত রাজা বিরাট তাঁকে যথেষ্ট ভক্তি করতেন না, এই অপরাধে শীতলা তাঁর রাজ্যে নানান আধিব্যাধির এমন মহামারী লাগিয়ে দেন যে, রাজা শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করেন। তিনি শীতলার করুণা ভিক্ষা করলে দেবীর মন গলে, বিরাটরাজ্য রোগমুক্ত হয়। মনসার কাহিনি মনে পড়ে। এই মহাশক্তিমতী স্থানীয় দেবীরা কেন কেবল শিবের সঙ্গেই টক্কর দিতেন, সেটা অবশ্য এক রহস্য।
একেবারে দক্ষিণ ভারতকে বাদ দিলে গোটা উপমহাদেশে শীতলা একটিই নামে পূজিত। এর থেকে মনে হয়, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার বিকাশের আগেই স্থানীয় লোকবিশ্বাসের একটা অভিন্ন চরিত্র ছিল। কারও কারও ধারণা, শবররা এই দেবীর পূজা প্রবর্তন করেন, কিন্তু এর কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আমরা পাইনি। তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে শীতলার পুজো করেন, কে কী ভাবে ব্যাধির প্রকোপকে দেখেন তার ওপরেই সেটা নির্ভর করে। বাংলায় তাঁর পুজো হয় বসন্তকালে, ফাল্গুন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চে। দখিনা বাতাস তো কেবল মিষ্টি প্রেম-ভালবাসাই নিয়ে আসে না, মহামারীর জীবাণুও বয়ে আনে। শীতলার সঙ্গে এই সময় পুজো পান কলেরা বা ওলাউঠার ভারপ্রাপ্ত ওলাদেবী, চর্মরোগের অধিষ্ঠাত্রী ঘেঁটু, রক্তের সংক্রমণ জনিত রোগের সঙ্গে জড়িত রক্তদেবী এবং আরও অনেকে: মোটামুটি একটা মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল বলা চলে।
অনার্যরা দিব্যি একটা পাথরখণ্ড বা অন্য কোনও প্রতীকের, এমনকী একটা কলসির পুজো করত। বহু যুগ ধরে শীতলা পূজিত হয়েছেন একটি কালো পাথর, কিংবা বটগাছের নীচে একটি বেদীর ওপর হলুদ কাপড়ে ঢাকা প্রস্তরখণ্ড রূপে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট মানবপ্রতিম মূর্তি না হলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চলে না।
ভারতের অনেক অঞ্চলেই বাংলার মাসখানেক আগে, মাঘের দ্বিতীয় পক্ষে শীতলা ষষ্ঠী পালিত হয়। পুরনো রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, পঞ্জাবের মতো কিছু অঞ্চলে জ্যৈষ্ঠের সপ্তম দিনটি শীতলা পুজোর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়, গুজরাতে আবার এ পুজো হয় শ্রাবণ মাসে। শীতলা মানে ঠান্ডা, তাঁর পুজোয় আগুন জ্বলে না, সব খাবার ঠান্ডা খাওয়ার রীতি। দেড়শো বছর আগে স্কটিশ মিশনারি জন মারডক লিখেছিলেন, ‘শীতলা পুজো একেবারে ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কেবল সন্তানবতী সধবারাই এই পুজো করেন।’
শীতলা দেখতে কেমন, সেটা আর এক ব্যাপার। অনার্যরা দিব্যি একটা পাথরখণ্ড বা অন্য কোনও প্রতীকের, এমনকী একটা কলসির পুজো করত। বহু যুগ ধরে শীতলা পূজিত হয়েছেন একটি কালো পাথর, কিংবা বটগাছের নীচে একটি বেদীর ওপর হলুদ কাপড়ে ঢাকা প্রস্তরখণ্ড রূপে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট মানবপ্রতিম মূর্তি না হলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চলে না। অতএব ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলা হল, শীতলাকে কল্পনা করতে হবে রক্তাম্বরা এক দেবী রূপে, যিনি ময়ূরবাহিনী, যাঁর হাতে ধরা একটি মোরগ। অঞ্চলভেদে এই দেবীর প্রতিমায় তারতম্য ঘটে, কোথাও কোথাও একটি ছোট্ট পুতুলের পুজোও হয়। বাংলায় এবং অন্য নানা জায়গায় শীতলা আসেন গাধার পিঠে চড়ে— আর সব বাহনকে ইতিমধ্যেই অন্য দেবদেবীরা দখল করে ফেলেছিলেন বলেই বোধহয়। তাঁর হাতে একটি ছোট ঝাঁটা, যা দিয়ে রোগজীবাণু তাড়াবেন; একটি কলসি, যার ঠান্ডা জলে রোগীকে আরাম দেবেন; আর একটি পাত্র, যার মধ্যে ব্যাধিকে বন্দি করবেন; আর আছে একটি চামর, যা দিয়ে ধুলোবালি থেকে জীবাণুকে আলাদা করবেন।
শীতলার আরাধনা নিয়ে গবেষণা করেছেন ফাব্রিসিয়ো ফেরারি, সম্প্রতি তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে। ফেরারি শীতলার মন্দির খুঁজে পেয়েছেন ভারতের নানা প্রান্তে— গুড়গাঁও থেকে পটনা, বারাণসী থেকে সালকিয়া, উত্তরপ্রদেশের আদলপুরা থেকে অসমের নগাঁও, জোধপুর-বাঢ়মের থেকে নেপালের বিরাটনগর, উত্তরাখণ্ড থেকে নাগপুর, জালন্ধর থেকে কলকাতা। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম বার বার শীতলাকে পরিশুদ্ধ করতে তৎপর হয়েছে, কিন্তু পেরে ওঠেনি, এটা তাঁর মাহাত্ম্যেরই প্রমাণ। গোটা দেশে তাঁর একই নাম, এটাও তাঁর সামর্থ্য এবং জনজীবনে গভীর শিকড়কেই চিনিয়ে দেয়। গুটিবসন্ত বিদায় নিয়েছে, কিন্তু মা শীতলা গাধায় চড়ে নিয়মিত আসছেন এবং ঝাঁট দিচ্ছেন।